দুর্যোগে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আইনত অপরাধ 

বিবিধ আইন

সিলেটের একটি ছোট্ট গ্রাম “পান্থনগর”। এই গ্রামের মানুষ সাধারণত কৃষিকাজ ও ছোটখাটো ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। গ্রামের মানুষদের মধ্যে সবাই পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে আসে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়। এক বছর, বর্ষার সময়, সিলেট অঞ্চলে প্রচণ্ড বন্যা শুরু হয়। গ্রামের মানুষদের ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়, ফসল নষ্ট হয়ে যায়, এবং তারা একবেলা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে শুরু করে। এই কঠিন সময়ে গ্রামের সবচেয়ে বড় মুদি দোকানদার নাসির উদ্দিন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে চাল, ডাল, চিড়া, মুড়ি, গ্যাসের সিলিন্ডার, এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক বাড়িয়ে দেন। 

নাসির উদ্দিনের দোকানে আসা প্রতিটি মানুষকে তিনি বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে থাকেন। তার বিশ্বাস ছিল যে এই দুর্যোগকালীন সময়ে কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলবে না, কারণ তাদের কাছে খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। অন্যদিকে, গ্রামের এক তরুণ শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম, যে শহরে থেকে পড়াশোনা করে, ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে আসে। সে দেখে তার গ্রামের মানুষগুলো নাসির উদ্দিনের দোকান থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বাধ্য হচ্ছে, কিন্তু দাম তাদের সাধ্যের বাইরে। রফিকুল বুঝতে পারে, এটি একটি ভয়াবহ অন্যায়। 

 

রফিকুল দ্রুত ইন্টারনেটে সার্চ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২ সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করে এবং সেখানে আইনের বিভিন্ন ধারা পড়ে। সে জানতে পারে, আইন অনুযায়ী, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কোনো ব্যবসায়ী যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ করে বা অতিরিক্ত মুনাফার উদ্দেশ্যে বিক্রি করে, তবে তা আইনত শাস্তিযোগ্য। রফিকুল গ্রামের মানুষদের সাথে আলোচনা করে এবং তাদেরকে বুঝায় যে, তারা যদি নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে আইনের সহায়তা নেয়, তবে তাদের এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মিলতে পারে। গ্রামের কিছু সাহসী মানুষ রফিকুলের কথায় রাজি হয় এবং তারা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দায়ের করে।

অভিযোগের পর প্রশাসন নাসির উদ্দিনের দোকানে অভিযান চালায়। তার বিরুদ্ধে মূল্যবৃদ্ধির অপব্যবহার ও পণ্য মজুদের প্রমাণ পায় এবং তাকে জরিমানা ও কারাদণ্ডের শাস্তি প্রদান করে। প্রশাসনের এই উদ্যোগ গ্রামের মানুষদের মধ্যে নতুন আশা জাগায় এবং তারা আবারও নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুর্যোগ মোকাবিলা করে।

 

 এটি একটি কাল্পনিক ঘটনা, কিন্তু বাস্তবে এমন অনেক বাস্তব ঘটনাও ঘটছে। বাংলাদেশ, একটি বন্যাপ্রবণ দেশ, যেখানে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা, নদীর ভাঙন, এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটছে, যার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব দুর্যোগের সময় মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার মত ঘটনা ঘটছে, যা সাধারণ জনগণের দুর্ভোগকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এ ধরনের অনৈতিক কার্যকলাপ রোধে বাংলাদেশের সরকার ২০১২ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন প্রণয়ন করেছে, যার একটি বিশেষ ধারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অপরাধ ও তার দণ্ড নির্ধারণ করেছে।

বাংলাদেশের বন্যাপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে, বিশেষ করে সিলেট, মৌলভীবাজার, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ উত্তর অঞ্চলের জেলায় বন্যার সময় সাধারণত শুকনা খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। বন্যা কবলিত জেলায় তো দাম বাড়ে বাড়ে, যদি ঢাকা শহর থেকে ত্রাণ নিয়ে কেউ বন্যা কবলিত এলাকায় যেতে চায়, তাতেও রক্ষা নেই। কারওয়ান বাজার, চকবাজার ও মৌলভীবাজারের মতো প্রধান বাজারগুলোতে মুড়ি, চিড়া, গুড়, মোমবাতি, এমনকি বোতলজাত পানিরও সংকট দেখা যায়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। 

 

বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে, উদাহরণ দিলে কলেজের শিক্ষার্থী, ত্রাণের জন্য মুড়ি-চিড়া কিনতে এসে মোমবাতি কিনতে ব্যর্থ হন। তারা বলেন, “মুড়ি ও চিড়া বাড়তি দাম দিয়ে কিনতে পারলেও মোমবাতি কিনতে পারিনি। দোকানদাররা বলছেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ সংকট থাকায় এসব এখন সোনার হরিণ বিশেষ করে মুড়ি-চিড়া ও মোমবাতি।” কারওয়ান বাজারের মুড়ি-চিড়া ব্যবসায়ী ও চকবাজারের মোমবাতির পাইকারি ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় তারা বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা জানান, মোমবাতির চাহিদা তিনগুণ বেড়েছে, কিন্তু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তা সরবরাহ করতে পারছে না। এদিকে, কারওয়ান বাজারের গুড় ব্যবসায়ী, জানান, “গুড় দোকানে আসার আগেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। অনেকে তো অগ্রিম টাকা দিয়ে রেখেছেন।” তাছাড়া, বন্যার পানির কারনে গ্রামের মানুষ যখন নিজ মাটির চুলায় রান্না করতে পারতেছে না, তখন গ্যাসের সিলিন্ডারের মূল্য বৃদ্ধির খবর পাওয়া যাচ্ছে। খবর পাওয়া যাচ্ছে নৌকা থেকে শুরু করে যাবতীয় যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধির খবর। মৃত মানুষকে ঠিকমতো কবর দেওয়া যাচ্ছে না উচু জায়গার অভাবে, সেখানে কিছু জায়গায় মৃতকে কবরস্থ করার জন্য যেসব জিনিসপত্র দরকার, সেগুলোর মূল্যও বৃদ্ধি করে দেওয়ার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। 

এইসব অনৈতিক কার্যকলাপকে রোধ করার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২ এর ধারা ৪০ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারা অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি অবৈধভাবে মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে দুর্গত এলাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করেন বা বৃদ্ধির কারণ সৃষ্টি করেন, তাহলে তাকে এক বছরের কারাদণ্ড বা এক লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। এই আইনটি একটি শক্তিশালী প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে, যা দুর্যোগের সময় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে।

 

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অসাধু ব্যবসায়ীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা বন্ধ করতে হলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২ এর ধারা ৪০ এর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এই আইনটি শুধুমাত্র একটি প্রতিরোধক নয়, এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে যা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমাতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষের জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে এবং তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এই আইনটির বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর তৎপরতা এবং জনগণের সচেতনতা এই আইনটির কার্যকারিতা বাড়াতে পারে, যা সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্য মঙ্গলজনক হবে। 

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.