অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা – কি, কেন, কিভাবে?

অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা

সাধারণ অর্থে আমরা নিষেধাজ্ঞা বলতে বুঝি যে, কোনো একটি কাজ করা হতে কাউকে নিষেধ করা। আর অস্থায়ী মানে হচ্ছে, যেটি স্থায়ী নয়। আইনের দৃষ্টিতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বিষয়টি অনেকটা ঐরকমই। যখন দেওয়ানি আদালতে কোন মামলা চলে, তখন কোন পক্ষকে কোন নির্দিষ্ট কাজ করতে বাধ্য করা বা কোন কাজ করা হতে বিরত থাকার জন্য আদালত যে আদেশ প্রদান করেন, তাকে নিষেধাজ্ঞা বলা হয়। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ১৮৭৭ এ ৩ (তিন) ধরনের নিষেধাজ্ঞার কথা সাধারণত বলা হয়েছে। যদিও প্রকারভেদ করতে গেলে অনেকেই একে দুই ভাগে বিভক্ত করে থাকেন, অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা এবং স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা। তবে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনে বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞা নামেও আরেকটি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আজকের এই পর্বে আমরা শুধুমাত্র অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করব। পরবর্তী পর্বগুলোতে আমরা স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা এবং বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞানী নিয়েও পর্যায়ক্রমে আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।

সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৫৩ ধারা এবং দেওয়ানী কার্যবিধির ৩৯ আদেশে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে এমন এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা, যা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কিংবা আদালতের পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কার্যকর থাকে এবং আদালত মামলার যেকোনো পর্যায়ে এই অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আদেশ দিতে পারে।

কখন অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার জন্য আবেদন করা যায়: এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কখন অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন করা যায়?- আমরা পূর্বেই বলেছি যে, মামলার মধ্যে যে দুই পক্ষ থাকে অর্থাৎ বাদী এবং বিবাদী, তাদের মধ্যে যেকোনো পক্ষ আদালতের কাছে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন করতে পারেন। অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন কখন করা যায় সেই বিষয়ে নিম্নে আলোচনা করা হল:

প্রথমত, কোন মামলায় যে বিষয় নিয়ে বিরোধ সে বিষয়বস্তুটি মামলার কোন পক্ষ দ্বারা অপচয়, ক্ষতিগ্রস্ত বা হস্তান্তরিত বা ডিক্রি জারিতে অন্যায় ভাবে বিক্রয় করা ঝুঁকি সম্মুখীন হয়ে থাকলে, সেই ক্ষেত্রে আদালত ঐ বিষয়বস্তুর উপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশের জন্য আবেদন করতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, বিবাদী তার পাওনাদারকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে তার সম্পত্তি অপসারণ বা হস্তান্তর করার হুমকি বা ইচ্ছা প্রকাশ করলে আদালত বাদীকে ঐ প্রতারিত হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশের জন্য আবেদন করতে পারেন।

আদালত কোন বিবেচনায় অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর/নামঞ্জুর করবেন: অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশের জন্য আবেদন তো করা হয়ে গেলো, এখন কিসের ভিত্তিতে আদালত সেটি মঞ্জুর বা নামঞ্জুর করবেন, চলুন নিম্নে সেটি দেখা যাক:

প্রথমত, বাংলায় একটি কথা রয়েছে, আগে দর্শনদারি, তারপর গুন বিচারি। যদিও বলা হয়ে থাকে আইনের চোখ অন্ধ, কিন্তু বিচারক তো আর অন্ধ নন। তাই যে কোন মোকদ্দমা বিচারকের কাছে উপস্থাপন করা হলে, বিচারক তার বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেই বুঝতে পারেন একটি মামলা কি অবস্থায় রয়েছে এবং সেই অনুপাতে যে ধরনের সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়, তাতে যে পক্ষের প্রাইমা পেসি (Prima Facie) কেস রয়েছে বলে অনুধাবন করা যায়, সেই ভিত্তিতে যদি দরখাস্তকারীর পক্ষে অর্থাৎ অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা যে পক্ষ আবেদন করেছেন, সেই পক্ষের দিকে প্রাইমা পেসি (Prima Facie) কেস থাকে, সেই ক্ষেত্রে আদালত তার আবেদনটি মঞ্জুর করতে পারে কিন্তু যদি দরখাস্তকারীর পক্ষে প্রাইমা পেসি (Prima Facie) কেস না থাকে, সে ক্ষেত্রে অস্থায়ী আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন না মঞ্জুর করতে পারেন।

 

দ্বিতীয়ত, দরখাস্তকারী যদি দেখাতে পারে যে এই অবস্থায় অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ প্রদান করা না হলে দরখাস্তকারীর অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। এমনকি এই ক্ষতি ভবিষ্যতে অর্থের বিনিময়েও পূরণ করা সম্ভব নয়। যার ফলে এই মুহূর্তে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ প্রদান করা আবশ্যক।

 

তৃতীয়ত, দরখাস্তকারী অবশ্যই যথাসময়ের মধ্যে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার জন্য আবেদন করতে হবে। যদিও অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন কত সময়ের মধ্যে আবেদন করতে হবে সে বিষয়ে কোন উল্লেখ নেই। কারণ মামলার যে কোন পর্যায়ে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন করা যায়। কিন্তু দরখাস্তকারীর যেই বিষয়টিকে উদ্দেশ্য করে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন দাবি করছেন, সেই বিষয়টির জন্য ওই দরখাস্ত যথাসময়ের মধ্যে করা হয়েছে কিনা আদালত সেই বিষয়টি বিবেচনা করবেন। যদি দেখা যায় যে, নামমাত্র অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন করা হয়েছে বা আদালতের কালক্ষেপণের জন্য আবেদন করা হয়েছে, তাহলে নামঞ্জুর হতে পারে। যে বিষয়ে উনি নিষেধাজ্ঞা দাবি করেছেন সেই বিষয়ে এখনই উপযুক্ত সময় আবেদন করার জন্য বা নিষেধাজ্ঞার আদেশ প্রদানের জন্য, সে ক্ষেত্রে আদালত মঞ্জুর করতে পারে।

চতুর্থত, অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা যেহেতু আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতা, সেই ক্ষেত্রে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করা এবং না করা উভয়ই আদালতের স্বেচ্ছাধীন। এই ক্ষেত্রে আদালত সুবিধার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য কখনো কখনো অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করতে পারেন আবার কখনো কখনো অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা না মঞ্জুর করতে পারে। একই মামলায় যেহেতু একপক্ষ নিষেধাজ্ঞার আবেদন করে, সেই ক্ষেত্রে আদালত ওই নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করলে কোন পক্ষের বেশি উপকার হবে, কোন পক্ষের বেশি অসুবিধা হবে অথবা দুই পক্ষের সুবিধা অসুবিধার যে ভারসাম্য, সেটি বজায় রেখে আদালত মঞ্জুর করতে পারেন অথবা নাম মঞ্জুর করতে পারে।

পঞ্চমত, আমরা পূর্বে আলোচনা করেছিলাম যে, অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা যেমন রয়েছে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। সাধারণত মামলার সকল সাক্ষ্যপ্রমাণ শেষে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। সেই ক্ষেত্রে কোন মোকদ্দমায় যদি বাদী স্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন করে থাকে এবং যে বিষয়টির উপর স্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন করা হয়েছে সেই বিষয়টিতে বর্তমান যদি অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ প্রদান করা না হয়ে থাকে তাহলে মামলা শেষে বাদি স্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ পেলেও অর্থহীন হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে আদালতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করতে পারেন।

এই হল, অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদ্যোপান্ত। ভবিষ্যতে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা এবং বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে লেখা প্রকাশিত হলে পড়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে আজ এখানেই ইতি টানছি, ধন্যবাদ।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ব্ল্যাংক চেক নিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন না তো?

অনলাইনে কেউ ভয়, বিরক্ত বা আক্রমণ করলে করণীয়

হানি ট্র্যাপ-মানি ট্র্যাপ: ভিকটিমের করনীয় কি?