আদালত অবমাননা আইন; কতিপয় কাজ আদালত অবমাননা নয়

বিবিধ আইন

বাংলাদেশের আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ এর ১০ নম্বর ধারাটি আদালত অবমাননার ধারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রমকে তুলে ধরেছে। এই ধারাটি সরকারি কর্মকর্তাদের আইনি দায়িত্ব পালনে সরল বিশ্বাসে এবং জনস্বার্থে কাজ করার ক্ষেত্রে সুরক্ষা প্রদান করে। এই আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে, যদি কোনো সরকারি কর্মচারী সৎ উদ্দেশ্যে আইন, বিধি বা প্রজ্ঞাপন অনুসরণ করে কোনো কাজ করেন, তবে সেই কাজ আদালত অবমাননা হিসেবে গণ্য হবে না। এ আর্টিকেলে আমরা আইনটির বিভিন্ন দিক, এর প্রয়োগ এবং এর সুরক্ষাগুলো উদাহরণসহ বিশ্লেষণ করবো।

১। সরল বিশ্বাস ও জনস্বার্থে কর্ম সম্পাদনঃ আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ আইনের ১০(১) ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো সরকারি কর্মচারী জনস্বার্থে এবং সরল বিশ্বাসে কোনো আইন বা বিধিমালা অনুসরণ করে কাজ করেন, তবে সেই কাজ আদালত অবমাননা হিসেবে গণ্য হবে না। 

উদাহরণস্বরূপ, একটি সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত প্রজ্ঞাপন অনুসরণ করে যদি একজন কর্মকর্তার কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় এবং সে পদক্ষেপ যদি কোনোভাবে আদালতের নির্দেশের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তবে সেটি আদালত অবমাননা হিসেবে বিবেচিত হবে না। এর মাধ্যমে কর্মকর্তারা আইন অনুযায়ী কাজ করতে এবং সরকারি নীতিমালা বাস্তবায়নে মুক্তভাবে কাজ করার সুযোগ পান।

আবার ধরুন, একটি বিশেষ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকার কোন জমির অধিগ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করে। স্থানীয় একজন উপ-কমিশনার (ডিসি) সেই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু করেন। যদি আদালত পরবর্তীতে সেই অধিগ্রহণকে অবৈধ ঘোষণা করে, তবে সেই ডিসি যদি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী জনস্বার্থে এবং সরল বিশ্বাসে সঠিকভাবে কাজ করে থাকেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা যাবে না। 

২। বাস্তবায়নে অসম্ভবতা ও প্রচেষ্টাঃ আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ এর ১০(২) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো সরকারি কর্মচারী আদালতের কোনো আদেশ বা নির্দেশ পালন করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেও তা বাস্তবায়ন করতে না পারেন, তবে সে ক্ষেত্রে আদালত অবমাননার অভিযোগ করা যাবে না। এই ধারাটি বাস্তব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেখানে সরকারি কর্মকর্তারা বিভিন্ন বাধা ও সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হন।

যেমন ধরুন, একটি আদালত কোনো বিশেষ এলাকা থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু, সেই এলাকার পরিস্থিতি যদি অত্যন্ত জটিল হয় এবং সেখানে উচ্ছেদ কার্যক্রম চালানো জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে থাকে, তবে সেই নির্দেশ পালন করা কর্মকর্তার পক্ষে অসম্ভব হতে পারে। এ ক্ষেত্রে, যদি তিনি সাধ্যমতো প্রচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন, তবে তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ করা যাবে না।

৩। আইন অনুযায়ী কাজের সুরক্ষাঃ আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ এর ১০ ধারার মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীরা আইনের শাসনের আওতায় থেকে কাজ করতে উৎসাহিত হন। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তাদের কাজ আইন ও বিধিমালা মেনে করতে হয়। এই ধারা কর্মকর্তাদের ভীতি ছাড়া কাজ করতে সাহায্য করে, কারণ তারা জানেন যে, সৎ উদ্দেশ্যে এবং সরল বিশ্বাসে আইন অনুসরণ করে কাজ করলে তারা আদালত অবমাননার শিকার হবেন না।

উদাহরণস্বরূপ, একজন সরকারি প্রকৌশলী কোনো সরকারি প্রকল্পের নির্মাণ কাজে ব্যস্ত। কাজ চলাকালে প্রকল্পের কোনো অংশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয় এবং নির্মাণ কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রকৌশলী যদি সেই নির্দেশ মেনে কাজ বন্ধ করে এবং তার কাজ যদি পূর্ববর্তী বিধিমালা ও প্রজ্ঞাপনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, তবে তার পূর্বের কাজ আদালত অবমাননা হিসেবে গণ্য হবে না।

৪। কার্যকর আইনি প্রতিকার ও আদালতের সম্মানঃ এখন প্রশ্ন আসতে পারে, আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ এর ১০ ধারা কি আদালতের সম্মান ও কর্তৃত্বকে খর্ব করে? বাস্তবে, না। কারণ আদালত অবমাননা আইন আদালতের সম্মান রক্ষা করতে এবং বিচার বিভাগের উপর আস্থা স্থাপন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, ১০ নম্বর ধারাটি সরকারি কর্মকর্তাদের সুরক্ষা প্রদান করে যাতে তারা আইন অনুযায়ী সঠিকভাবে কাজ করতে পারেন। এটি একটি ভারসাম্য রক্ষা করে একদিকে আইনের শাসনের প্রতি সম্মান দেখানো হয়, অন্যদিকে সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করতে উৎসাহিত করা হয়।  

যেমন ধরুন, একজন পুলিশ অফিসার আদালতের নির্দেশে কোনো বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানের সময় তিনি আদালতের নির্দেশের বাইরে গিয়ে কিছু করেননি বরং আইন মেনেই কাজ করেছেন। কিন্তু অভিযানের ফলস্বরূপ আদালতের নির্দেশ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এক্ষেত্রে, তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ তোলা যাবে না কারণ তিনি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন।

৫। আইন প্রয়োগে কিছু চ্যালেঞ্জঃ আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ এর ১০ ধারা ব্যবহার করে কখনো কখনো অপব্যবহারও হতে পারে, যেখানে কিছু কর্মকর্তা নিজেদের কাজকে সরল বিশ্বাসের নামে রক্ষা করার চেষ্টা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে, আদালত তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবেন এবং সত্যিকারের সরল বিশ্বাসে কাজ হয়েছে কি না তা যাচাই করবেন। 

উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তা সরল বিশ্বাসের দোহাই দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে আদালতের নির্দেশ অমান্য করেন এবং তা প্রমাণিত হয়, তবে তিনি আইনের সুরক্ষা পাবেন না এবং তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

সবশেষে, আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ এর ১০ নম্বর ধারা সরকারী কর্মচারীদের দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি সুরক্ষা প্রদান করে। এটি কর্মকর্তাদের আইন মেনে কাজ করার স্বাধীনতা দেয় এবং তাদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন আদালত অবমাননার অভিযোগ প্রতিরোধ করে। তবে, এর অপব্যবহার রোধ করা ও সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে আমরা এর সুফল উপভোগ করতে পারবো।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.