প্রাপ্তবয়স্ক প্রেমিকার সম্মতিতে সম্পর্ক: আইনের দৃষ্টিতে দায়বদ্ধতা ও প্রতিকার

নোমান আর মৌসুমি, কলেজের সেই উজ্জ্বল দিনের বন্ধু। দু’জনই ছিল স্বপ্নবাজ, ভবিষ্যৎকে নিজেদের মতো গড়ে তোলার তাগিদে এক অদ্ভুত প্রেরণায় দীক্ষিত। নোমান ছিল প্রাণচঞ্চল, প্রতিটি কাজে উদ্যমী আর মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগে থাকা এক উজ্জ্বল তরুণ। ক্লাসের সবাই তাকে ভালোবাসত তার সেই বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব আর সহজ হাসির জন্য। মৌসুমি ছিল ঠিক তার বিপরীত, কিছুটা লাজুক, নিরব; তবে তার নীরব মৃদু হাসিতে যেন এক অপার্থিব স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ত।

প্রথম প্রথম নোমান আর মৌসুমির দেখা-সাক্ষাৎ ছিল কেবল ক্লাস আর লাইব্রেরির আঙিনায়। কিন্তু যত দিন গড়াতে থাকে, দু’জনের মনোভাবের মধ্যে যেন এক অদৃশ্য সেতু তৈরী হতে থাকে। নোমান ধীরে ধীরে খুঁজে পায় সেই মৌসুমিকে, যার সাথে থাকা মানেই এক ধরনের প্রশান্তি। মৌসুমি ও নোমানের কাছে খুঁজে পায় এমন একজনকে, যে তার কথার নীরব শ্রোতা, তার প্রতিটি ভাবনার গভীর সহানুভূতিশীল অংশীদার।

সময়ের সাথে সাথে তাদের বন্ধুত্বের রং গাঢ় হতে থাকে, এক এক সময় কেমন যেন একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে সম্পর্কটা। প্রেমের রঙিন রূপকথায় তারা তখন গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে। নোমান কেবল বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি নয়, মৌসুমির ভবিষ্যৎ জীবনেরও অংশ হতে চায়। সে মৌসুমিকে বারবার আশ্বাস দেয়, “আমি তোমার সঙ্গেই থাকব, আমি তোমায় ছেড়ে যাব না।” মৌসুমির মনে তখন এক অপরূপ নিরাপত্তা, এক চিরস্থায়ী ভালোবাসার ছায়ায় দাঁড়িয়ে সে যেন তার জীবনের প্রত্যাশাগুলো একের পর এক পূরণ হতে দেখে।

তাদের এই সম্পর্ক ছিল যথেষ্ট গোপনীয়তার মধ্যে। নিজেদের পরিবার জানে না এই সম্পর্কের গভীরতা সম্বন্ধে। বিশেষ করে, সমাজের প্রচলিত নিয়মে এই সম্পর্ক ছিল এক ভিন্ন ব্যাখ্যা, যা তারা কাউকে বলতে পারে না। কিন্তু তাদের ভালোবাসার মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায় একটি ঘটনা, যা তাদের জীবনের গতিপথ পাল্টে দেয়।

একদিন দুপুরে, মৌসুমির বাবা হঠাৎ করে বাড়িতে ফিরে আসেন। অপ্রত্যাশিত সেই আগমনে, তিনি বাড়ির পরিবেশে কেমন যেন অস্বাভাবিক কিছু অনুভব করেন। বাড়ির নীরবতা তখন এক অদ্ভুত চাপের ইঙ্গিত বহন করছে। তিনি ধীরে ধীরে তার মেয়ের ঘরের দিকে এগিয়ে যান, দরজা খুলেই চোখে পড়ে সেই দৃশ্য যা কোনো বাবার চোখে দেখা সহজ নয়। তিনি দেখেন নোমান এবং মৌসুমি একে অপরের অত্যন্ত কাছাকাছি, এক মায়াময় কিন্তু সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে।

মুহূর্তেই সেই নীরবতা ভেঙে পড়ে এক ধ্বংসাত্মক রূপে। মৌসুমির বাবা এই অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। নোমানকে হাতের কাছে যা পান তাই দিয়ে মারতে শুরু করেন। তার চোখে তখন শুধু প্রতারণার ছাপ, এক শাস্তি চাওয়ার জেদ। মারধর তখন শুধু নোমানকেই নয়, মৌসুমির উপরও কিছুটা বর্ষিত হয়। পরিবারের সম্মান এবং বিশ্বাস ভঙ্গের অনুভূতিতে ক্ষত-বিক্ষত বাবা তখন নিজের কন্যাকেও কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে দেন না। সেই মুহূর্তে মৌসুমির মনে হয় যেন তার জীবনের সমস্ত রঙ হারিয়ে গেছে, সে যেন অন্ধকারে ডুবে গিয়েছে।

এই ঘটনার পর মৌসুমির বাবা তাকে বাধ্য করেন সব কিছু খুলে বলতে। মৌসুমি কোনো উপায় না দেখে ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছুই বাবার কাছে প্রকাশ করে। কাঁদতে কাঁদতে সে তার বাবাকে জানায় যে নোমান তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই প্রতিশ্রুতির আশ্রয়ে সে নিজেকে নোমানের হাতে তুলে দিয়েছিল।

নোমান এবং মৌসুমির এই সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে মামলা করা হয়, যেখানে মৌসুমি অভিযোগ করে যে নোমান তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। মামলায় নোমানের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয় যে, মৌসুমি প্রাপ্তবয়স্ক এবং তিনি নিজের সম্মতিতে এই সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। বিষয়টি আদালতে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করে এবং আইনজীবীরা কামাল হোসেন ওরফে মোঃ কামাল প্রামাণিক বনাম রাষ্ট্র মামলার নজীর উল্লেখ করে আলোচনা করেন।

আইনের আলোকে ধর্ষণ এবং প্রতিশ্রুতিঃ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ৯(১) ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো পুরুষ নারীর সম্মতি ছাড়া বা ভয় প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায় করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন, তবে সেটি ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। তবে এই ক্ষেত্রে, যেহেতু মৌসুমি প্রাপ্তবয়স্ক এবং তার সম্মতি ছিল, এবং আদালত মনে করেন যে নোমানের প্রতিশ্রুতি প্রতারণামূলক নয়, তাই এটি ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হয়নি।

আইনের দৃষ্টিতে “প্রাপ্তবয়স্কের সম্মতিঃ কামাল হোসেন ওরফে মোঃ কামাল প্রামাণিক বনাম রাষ্ট্র (৬১ ডিএলআর ২০০৯) মামলার রায়ে, আদালত বলেছিলেন যে, যদি একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী নিজে স্বাধীনভাবে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন, তবে তার জন্য আইনি প্রতিকার প্রায় সীমিত থাকে। এই মামলায়ও দেখা যায়, নোমান মৌসুমিকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে প্রলুব্ধ করলেও মৌসুমি নিজেই এই সম্পর্কে সম্মত ছিলেন। 

আদালতের রায়ের মূল বিষয়:

  • প্রাপ্তবয়স্কের স্বাধীনতা: আদালত স্বীকার করেছে যে, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে।
  • সম্মতির গুরুত্ব: যদি কোনো নারী স্বেচ্ছায় কোনো সম্পর্ক স্থাপন করে, তবে পরবর্তীতে সেই সম্পর্কের ফলাফলের জন্য তিনি নিজেই দায়ী।
  • প্রতারণার অভাব: মামলায় প্রতারণার কোনো যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

 

আইনি দৃষ্টিকোণ: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুযায়ী, সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন করে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা ধর্ষণ। কিন্তু এই মামলায়, ভীতি বা প্রতারণার কোনো প্রমাণ না থাকায় আদালত ধর্ষণের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।

 

উপরের নামগুলো কাল্পনিক কিন্তু এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে আমাদের সমাজে। এই ধরণের ঘটনা এবং উক্ত মামলার রায় আমাদের তরুণদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্বরূপ। প্রেম, বিশ্বাস, প্রতারণা, আইন – এই সব কিছু এখানে জড়িত। আদালতের রায় স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সিদ্ধান্তের জন্য তাকে নিজেই দায়ী হতে হবে। তাই, একজন ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর আগে এবং বিশেষ করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বে এর সম্ভাব্য সকল ফলাফল সম্বন্ধে অবগত থাকা বাঞ্ছনীয়।

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.

এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন

Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )
Picture of Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

Advocate Chowdhury Tanbir Ahamed Siddique

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন। ( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )

আরো পড়ুন

ব্ল্যাংক চেক নিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন না তো?

অনলাইনে কেউ ভয়, বিরক্ত বা আক্রমণ করলে করণীয়

হানি ট্র্যাপ-মানি ট্র্যাপ: ভিকটিমের করনীয় কি?