মানিলন্ডারিং কি এবং এর শাস্তি কি?

বিবিধ আইন

মানিলন্ডারিং কাকে বলে?   

মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ধারা ২ এর (ফ) অনুসারে, ‘‘মানিলন্ডারিং’’ অর্থ এমন কিছু কার্যক্রম যা অপরাধলব্ধ সম্পত্তি বা আয়ের অবৈধ উৎস গোপন, আড়াল, রূপান্তর বা হস্তান্তর করে, যা আইনত শাস্তিযোগ্য। নিচে প্রতিটি পয়েন্টের ব্যাখ্যা এবং উদাহরণ দেওয়া হলোঃ

(অ) অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত সম্পত্তি জ্ঞাতসারে স্থানান্তর বা রূপান্তর বা হস্তান্তরঃ

১। অপরাধলব্ধ আয়ের অবৈধ প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ গোপন বা ছদ্মাবৃত্ত করা। অর্থাৎ, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে অর্জিত সম্পত্তির প্রকৃত উৎস, মালিকানা, অবস্থান ইত্যাদি গোপন করার জন্য সেটিকে অন্য কোন সম্পত্তিতে রূপান্তর করা বা অন্যের নামে স্থানান্তর করা। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি অবৈধভাবে আয় করা টাকা দিয়ে ঢাকায় একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনে এবং সেই ফ্ল্যাটের মালিকানা তার এক আত্মীয়ের নামে স্থানান্তর করে।

২। সম্পৃক্ত অপরাধ সংগঠনে জড়িত কোন ব্যক্তিকে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ হতে রক্ষার উদ্দেশ্যে সহায়তা করা। অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তিকে আইনি প্রক্রিয়া থেকে বাঁচাতে অপরাধলব্ধ সম্পত্তি অন্যত্র সরিয়ে ফেলা বা রূপান্তর করা। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি তার বন্ধু, যে একটি বড় কর্পোরেট স্ক্যামে জড়িত, তাকে রক্ষা করতে তার অজান্তে সেই আয়ের একটি অংশ বিদেশে বিনিয়োগ করে।

  • (আ) বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পত্তি নিয়ম বর্হিভূতভাবে বিদেশে পাচার করাঃ অবৈধ বা বৈধ আয়কে আইন লঙ্ঘন করে অন্য দেশে পাঠানো, যা সাধারণত ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য বা অন্যান্য অবৈধ উদ্দেশ্যে করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যবসায়ী তার অবৈধভাবে অর্জিত টাকা লুকানোর জন্য বাংলাদেশ থেকে বিদেশে সেই অর্থ পাঠায় এবং সেখানে সম্পত্তি কিনে।
  • (ই) অপরাধলব্ধ আয়ের অবৈধ উৎস গোপন বা আড়াল করার উদ্দেশ্যে তার হস্তান্তর, বিদেশে প্রেরণ বা বিদেশ থেকে বাংলাদেশে প্রেরণ বা আনয়ন করাঃ অপরাধলব্ধ আয়কে গোপন বা আড়াল করার উদ্দেশ্যে দেশের মধ্যে বা বাইরে লেনদেন করা। উদাহরণস্বরূপ, একটি জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থকে বৈধ আয়ের মত দেখানোর জন্য একজন ব্যক্তি সেই অর্থকে ব্যাংকিং চ্যানেল দিয়ে বিদেশে পাঠায় এবং পরে তা দেশে ফিরিয়ে আনে।
  • (ঈ) কোন আর্থিক লেনদেন এইরূপভাবে সম্পন্ন করা যাতে এই আইনের অধীন তা রিপোর্ট করার প্রয়োজন হবে নাঃ অর্থ লেনদেন এমনভাবে সম্পন্ন করা যাতে এই আইন অনুযায়ী তা রিপোর্ট না করা লাগে বা নজর এড়িয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি অনেকগুলো ছোট ছোট পরিমাণে অর্থ উত্তোলন বা স্থানান্তর করে যাতে ব্যাংকের রিপোর্টিং সিস্টেমে ধরা না পড়ে।
  • (উ) সম্পৃক্ত অপরাধ সংঘটনে প্ররোচিত করা বা সহায়তা করার অভিপ্রায়ে কোন বৈধ বা অবৈধ সম্পত্তির রূপান্তর বা স্থানান্তর বা হস্তান্তর করাঃ অপরাধমূলক কাজ করতে কাউকে সহায়তা করার জন্য সম্পত্তির স্থানান্তর বা রূপান্তর করা। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি তার সঙ্গীকে একটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য অর্থ প্রদান করে এবং সেই অর্থকে বৈধ সম্পত্তি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে।
  • (ঊ) সম্পৃক্ত অপরাধ হতে অর্জিত জানা সত্ত্বেও এই ধরণের সম্পত্তি গ্রহণ, দখলে নেওয়া বা ভোগ করাঃ অপরাধমূলক কাজ থেকে অর্জিত সম্পত্তি জেনে বুঝেও গ্রহণ করা বা ব্যবহার করা। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি জানে যে একটি গাড়ি চুরি করা হয়েছে, তারপরও সেই গাড়িটি সে কিনে এবং ব্যবহার করে।
  • (ঋ) এইরূপ কোন কার্য করা যার দ্বারা অপরাধলব্ধ আয়ের অবৈধ উৎস গোপন বা আড়াল করা হয়ঃ যে কোনো কার্যকলাপ যা অপরাধমূলক আয়ের অবৈধ উৎসকে গোপন বা আড়াল করার জন্য করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি অবৈধ আয় দিয়ে একটি কোম্পানি খোলে এবং সেই কোম্পানির মাধ্যমে আয়ের উৎস গোপন করে।
  • (এ) উপরে বর্ণিত যে কোন অপরাধ সংঘটনে অংশগ্রহণ, সম্পৃক্ত থাকা, অপরাধ সংঘটনে ষড়যন্ত্র করা, সংঘটনের প্রচেষ্টা অথবা সহায়তা করা, প্ররোচিত করা বা পরামর্শ প্রদান করা। অর্থাৎ, শুধু যে মানিলন্ডারিং করবে সে অপরাধী নয়, তার সাথে যারা সম্পৃক্ত বা যারা মানিলন্ডারিং এর ষড়যন্ত্র করবে, মানিলন্ডারিং এর প্রচেষ্টা করবে বা প্ররোচিত করবে, এমনকি পরামর্শ দিবে তারাও একইভাবে অপরাধী হবে। 

মানিলন্ডারিং অপরাধের শাস্তি কি?

মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ ধারা অনুযায়ী, মানিলন্ডারিং একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। এই অপরাধের জন্য নিম্নলিখিত শাস্তির বিধান রাখা হয়েছেঃ

কারাদণ্ডঃ যদি কেউ মানিলন্ডারিং করে, অথবা এই অপরাধ করতে চেষ্টা করে, সহায়তা করে, বা ষড়যন্ত্র করে, তাহলে তাকে সর্বনিম্ন ৪ বছর এবং সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হবে।

অর্থদণ্ডঃ অপরাধীর বিরুদ্ধে অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ অর্থদণ্ড আরোপ করা হবে, অথবা ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দেওয়া হবে, যা বেশি হবে। যদি কেউ আদালতের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্থদণ্ড পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আদালত অপরিশোধিত অর্থদণ্ডের পরিমাণ অনুযায়ী অতিরিক্ত কারাদণ্ড দিতে পারে।

সম্পত্তি বাজেয়াপ্তঃ আদালত অপরাধীকে দণ্ডিত করার পাশাপাশি অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আদেশও দিতে পারে।

প্রতিষ্ঠানের শাস্তিঃ যদি কোনো প্রতিষ্ঠান এই অপরাধ করে, তাহলে প্রতিষ্ঠানকে উল্লেখিত শাস্তি দেওয়া হবে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি ২০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড পেতে পারে, এবং সেই প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করা হতে পারে। যদি প্রতিষ্ঠান আদালতের সময়সীমার মধ্যে অর্থদণ্ড পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠানটির মালিক, চেয়ারম্যান বা পরিচালকের বিরুদ্ধে কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হতে পারে।

অন্য অপরাধের সাথে সম্পর্কঃ মানিলন্ডারিং অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হতে, অপরাধের সাথে সম্পর্কিত অন্য কোন অপরাধে অভিযুক্ত বা দণ্ডিত হওয়া প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ, মানিলন্ডারিং অপরাধ হিসেবে এককভাবেই শাস্তিযোগ্য।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.