রাজনৈতিক আশ্রয়

রাজনৈতিক আশ্রয় – কি, কেন, কিভাবে?

বিবিধ আইন

রাজনৈতিক মামলার সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। পৃথিবীর যত দেশে রাজনীতি রয়েছে ঠিক তত দেশেই এক পক্ষ আরেক পক্ষকে হেনস্তা করতে কিংবা বিপক্ষ দলকে দুর্বল করতে এককথায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে যে মামলাগুলো করে থাকে, সেগুলোকে ‘রাজনৈতিক মামলা‘ বলা হয়ে থাকে। এটি রাজনীতির একটি নেতিবাচক দিক। তবে সব রাজনৈতিক মামলা যে আবার হেনস্তা করার উদ্দেশ্যে তাও কিন্তু নয়। অনেক সময় প্রকৃত অপরাধীরাও নিজেদের কৃত অপরাধের ফলে যে মামলার সম্মুখীন হয়ে থাকেন, সেগুলোকে ‘রাজনৈতিক মামলা’ বলে চালিয়ে দেয়া হয়। এই রাজনৈতিক মামলার পাশাপাশি অন্য যে কোনো কারণে যেমন ধর্মীয়, জাতি বা গোষ্ঠীগত কোনো সমস্যার কারণে কোনো ব্যক্তি যদি নিজ রাষ্ট্রকে অনিরাপদ মনে করে তবে যথাযথ কারণ দেখিয়ে অন্য যে কোনো রাষ্ট্রের কাছে বসবাসের জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারে। এই আশ্রয়কে বলা হয় ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’।

 

‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ একটি আন্তর্জাতিক মৌলিক মানবাধিকার। এই অধিকার যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো রাষ্ট্রের কাছেই চাইতে পারে এবং দুটি অবস্থা ছাড়া যে কোনো রাষ্ট্র নীতিগত দিক থেকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে বাধ্য। রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে অপারগতা প্রদর্শনের প্রথম কারণটি হচ্ছে, যদি সম্ভাব্য আশ্রয় প্রদানকারী রাষ্ট্রের নিজের জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোনো সন্দেহ থাকে তখন ঐ রাষ্ট্র আবেদনকারী ব্যক্তিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে বাধ্য নয়। দ্বিতীয়ত, আশ্রয়ের আবেদনকারী যদি গুরুত্বর কোনো অপরাধে বা ওই ব্যক্তির নিজ দেশের সমাজের জন্য বিপজ্জনক কোনো অপরাধের অপরাধ হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হয়ে থাকে, তাহলেও ওই ব্যক্তিকে কোনো রাষ্ট্র রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান থেকে নির্দ্বিধায় বিরত থাকতে পারে। উল্লিখিত দুই কারণ ছাড়া যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো রাষ্ট্রের কাছে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ এক ধরনের অধিকার হিসেবে দাবি করতে পারে।

 

এখন দেখা যাক, কিভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় অধিকার হিসেবে পাওয়া যায় বা দেওয়া যায়। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ১৪ (ক) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে যে, “নিজ রাষ্ট্রে রাজনৈতিক বা আদর্শগত কারণে নিপীড়ন বা গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির অন্য রাষ্ট্রের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করার এবং আশ্রয় পাওয়ার অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক, আদর্শগত বা ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের জন্য কোনো ব্যক্তি যদি তার নিজ রাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত হয় অথবা যদি তাকে তার প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয় বা স্বাভাবিক জীবনযাপনের পথে হুমকি তৈরি হয়, তাহলে ওই ব্যক্তি অন্য রাষ্ট্রে প্রবেশ ও বসবাসের জন্য যে অনুমতি প্রার্থনা করে সেটাই রাজনৈতিক আশ্রয়ের অধিকার। নির্যাতন, যন্ত্রণা, ক্লেশ, রাজনৈতিক উত্তেজনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই কেবল রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া যাবে। কিন্তু কোনো অরাজনৈতিক কাজ করে অভিযুক্ত হওয়ার পর রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলে তা পাওয়া যাবে না। আবার জাতিসংঘের নীতির বিরুদ্ধে কোনো কাজে কেউ অভিযুক্ত হলে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় নাও পেতে পারেন।

 

রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান করাটা আশ্রয়দানকারী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের বহিঃপ্রকাশ, যা ওই রাষ্ট্র নিজস্ব বিবেচনায় প্রদান করে থাকে। এই আশ্রয় বিভিন্ন উপায়ে দেয়া হয়। যেমন, প্রথার ভিত্তিতে কিংবা চুক্তির ভিত্তিতে ইত্যাদি। তবে চুক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক আশ্রয় সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। আশ্রয়দানকারী রাষ্ট্রের আশ্রয় দানের ক্ষমতাকে অঞ্চলের ভিত্তিতে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমত, ভূখণ্ডগত আশ্রয়; দ্বিতীয়ত, অতি-রাষ্ট্রিক আশ্রয়

 

ভূখণ্ডগত আশ্রয় সম্বন্ধে আমরা সবাই কমবেশি অবগত। ইংরেজিতে একে বলে ‘টেরিটোরিয়াল এসাইলাম’। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কারণে গ্রেপ্তার, নির্যাতন, হুমকির ইত্যাদির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে সেই ব্যক্তি অন্য কোনো রাষ্ট্রে প্রবেশ করে সেই রাষ্ট্রের কাছে আশ্রয় চাইতে পারেন। তখন ওই রাষ্ট্র সেই ব্যক্তিকে তাদের নিজ ভূখণ্ডে আশ্রয় প্রদান করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আবারে বলতে হয়, রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান করাটা আশ্রয়দানকারী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের বহিঃপ্রকাশ, যা ওই রাষ্ট্র নিজস্ব বিবেচনায় নিয়ে থাকে। আশ্রয় প্রদানকারী রাষ্ট্র তাদের জাতীয় নিরাপত্তাজনিত কারণে আশ্রয় দিতে অস্বীকার জ্ঞাপন করতে পারে। আবার জনসংখ্যার মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যায় আশ্রয়প্রার্থী থাকলে তখনও নিজ রাষ্ট্রের জনগণের জন্য হুমকি সৃষ্টি হতে পারে এমনটা ভেবে আশ্রয় নাও দিতে পারে। যেমন— মিয়ানমারে যখন মুসলিম রোহিঙ্গারা নিজ দেশে নির্যাতিত হচ্ছিল, তখন তার আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে পাড়ি জমায়। বাংলাদেশ প্রথমে তাদের আশ্রয় দিলেও যখন তা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছিল, তখন তা স্থানীয় জনগণের জন্য হুমকি ভেবে বাংলাদেশ সরকার আশ্রয় প্রদানে অস্বীকার করে। তবে এ ক্ষেত্রে আশ্রয় দিতে না পারলেও ওই রাষ্ট্রের উচিত অন্য কোনো উপায়ে যেমন সাময়িক আশ্রয় প্রদান করে বা অন্য তৃতীয় কোন রাষ্ট্রে যেতে বা আশ্রয় লাভ করতে সাহায্য করা। এই ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া উচিত। তবে ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত ভূখণ্ডগত আশ্রয় সংক্রান্ত ঘোষণা বলছে, নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আশ্রয়প্রার্থীকে রাষ্ট্রীয় সীমানায় চেকপয়েন্টে প্রত্যাখান করা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি ভূখণ্ডে প্রবেশ করেই থাকে তাহলে তাকে ফেরত পাঠানো যাবে না। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের মধ্যে কিছু চুক্তি বা ট্রিটি করাই থাকে যে, রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হবে। সেসব চুক্তি অনুসারে, ভূখণ্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া নিয়ে কোনো প্রকার প্রশ্ন থাকে না।

 

শুধু নিজ ভূখণ্ডে নয় এর বাইরে গিয়েও একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে পারে। যার কারণে একে ইংরেজিতে বলা হয় ডিপ্লোমেটিক এসাইলাম’ বা ‘এক্সটা-টেরিটোরিয়াল এসাইলাম। এ ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্র তার রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার এখতিয়ারকে কিছুটা বৃদ্ধি করে বলা যায়। কেননা, এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীকে আশ্রয় প্রদানকারী রাষ্ট্রে প্রবেশ করার প্রয়োজন হয় না। যে রাষ্ট্র তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে প্রস্তুত, সেই রাষ্ট্রের দূতাবাসে প্রবেশ করলেই ওই দূতাবাস তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে পারবে। কেননা প্রত্যেক দেশে নিযুক্ত হাই কমিশনাররা যে দূতাবাসে অবস্থান করেন তা তাদের রাষ্ট্রের ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই নিজ দেশে থেকেও অন্য দেশের দূতাবাসে ‘রাজনৈতিক ‘আশ্রয়’ নেয়া সম্ভব। ডিপ্লোমেটিক এসাইলামের ক্ষেত্রে একটি বিখ্যাত মামলা রয়েছে, মামলাটি ‘এসাইলাম কেইস’ নামে বিখ্যাত। এই মালাটি হয়েছিল কলম্বিয়া ও পেরুর মধ্যে। এই মামলাটি হয়েছিল ১৯৫০ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে)। এই মামলায় পেরুর ওই অভিযুক্ত ব্যক্তি রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সামরিক অভ্যুত্থানের। ওই ব্যক্তি কলম্বিয়ার দূতাবাসে আশ্রয় নেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এই মামলার রায়ে আশ্রয় দেওয়া থেকে বিরত থাকতে কলম্বিয়াকে আদেশ দেয়। এখানে উল্লেখ্য যে, দূতাবাসে আশ্রয়কে আদালত প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, তবে অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ কোনো সাধারণ অপরাধ ছিল না বিধায় তাকে আশ্রয় দিতে অস্বীকারের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তবে এটি একটি প্রথা, যা ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে বেশি প্রচলিত। দক্ষিণ এশিয়া তথা এশিয়াতেও এমন প্রথা এখনো খুব একটা প্রচলন পায়নি। আর আইনে সবসময় সেই প্রথাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয় যা অনেক দিন ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে। তাই এই প্রথাটি আমাদের দেশের জন্য কার্যকর নয় বললেই চলে। আবার ব্যবসায়িক জাহাজ কিংবা যুদ্ধ জাহাজেও রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার নজির রয়েছে। জাহাজে যে রাষ্ট্রের পতাকা ব্যবহার করা হয়, সেই রাষ্ট্র যদি কোনো ব্যক্তিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে সম্মত হয়, তবে ওই জাহাজে আশ্রয়প্রার্থীকে আশ্রয় দেয়া যাবে। স্থায়ীভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় না দেয়া হলেও সাময়িক আশ্রয় দেয়ার অধিকার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের রয়েছে। এসব আশ্রয় মূলত মানবিক বিবেচনা দেয়া হয়ে থাকে।

 

রাজনৈতিক আশ্রয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি কাজ করে সেটি হচ্ছে আশ্রয় প্রার্থনাকারী সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক, আদর্শগত বা ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত কিনা এবং তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য কিনা। কেননা রাজনৈতিক আশ্রয় তাদেরই প্রাপ্য যারা কোনো দলের নেতা ছিলেন বা আছেন, এখন তাকে রাজনৈতিকভাবে হয়রানি, গ্রেপ্তার, নিপীড়ন করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বা মামলা করা হয়েছে বা সে যে ধর্মাবলম্বী সেই ধর্মের লোকের ওপর তার দেশে নিপীড়ন চলছে ঠিক এমন ব্যক্তিদের। সত্যিকার অর্থে একজন অপরাধীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হলেও আন্তর্জাতিক আইন সবসময় অপরাধীর শাস্তি কামনা করে। তাই অরাজনৈতিক ব্যক্তি কিংবা গুরুতর অপরাধীরা বা রাষ্ট্র বা জাতিসংঘের নীতি লঙ্ঘনকারীরা এই আশ্রয়ের সুযোগ-সুবিধার আওতামুক্ত।
কীভাবে এই রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে হবে, তা নিয়ে ভবিষ্যতে লিখবো, আজ এই পর্যন্তই। ধন্যবাদ। 

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.