রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার: সংজ্ঞা, প্রয়োজনীয়তা ও ইতিহাস

বিবিধ আইন

রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার (In-Camera Trial) হলো এমন একটি বিচার প্রক্রিয়া যেখানে সাধারণ জনগণের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে এবং বিচার কার্যক্রম কেবল আদালতের নির্ধারিত ব্যক্তি বা পক্ষগণের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণত, বিচারিক প্রক্রিয়া উন্মুক্ত থাকলেও কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে বিচারকের নির্দেশে বা আইনানুগ প্রয়োজন অনুযায়ী রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার অনুষ্ঠিত হয়।

আরও সহজ করে বললে, রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে আদালতের কক্ষের প্রবেশাধিকার শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট বিচারক, আইনজীবী, উভয়পক্ষ এবং প্রয়োজনীয় আদালতের কর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। বিচারটি সাধারণ মানুষের কাছে প্রকাশিত হয় না এবং এতে গোপনীয়তা রক্ষিত থাকে।

রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচারের প্রয়োজনীয়তা

রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার করার প্রধান কারণ হলো বিচারিক প্রক্রিয়ায় গোপনীয়তা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা। অনেক ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য বা পারিবারিক বিবাদগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা অনুচিত। পারিবারিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকেও এমন বিচার প্রয়োজন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পারিবারিক মামলাগুলোতে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার করা হয় যাতে বিচারপ্রার্থী ব্যক্তি বা তাদের পরিবারের সম্মানহানি না ঘটে। এছাড়াও, যেসব মামলায় গোপনীয় তথ্য থাকে (যেমন বাণিজ্যিক তথ্য, নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য ইত্যাদি) সেসব ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়।

 

রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচারের কয়েকটি মূল কারণঃ 

  • ১। গোপনীয়তা: পারিবারিক মামলায় ব্যক্তিগত এবং স্পর্শকাতর তথ্য থাকে যা জনসমক্ষে আলোচনা করলে ব্যক্তিগত সম্মানহানি ঘটতে পারে। রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার সেই গোপনীয়তা নিশ্চিত করে। যেমন, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা, বা ব্যক্তিগত সম্পর্ক সংক্রান্ত মামলাগুলিতে রুদ্ধদ্বার বিচার করা হয় যাতে ভুক্তভোগী বা সাক্ষীরা তাদের গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারেন।
  • ২। মানসিক স্বস্তি: পারিবারিক বিরোধের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের জন্য খোলামেলা বিচার মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার সেই চাপ কমাতে সাহায্য করে।
  • ৩। শান্তিপূর্ণ সমাধান: রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার অধিক শান্তিপূর্ণ ও নিরবিচ্ছিন্ন পরিবেশে সম্পন্ন হয়, যেখানে উভয় পক্ষ নিজেদের অবস্থান সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন।
  • ৪। সামাজিক প্রভাব নিয়ন্ত্রণ: কিছু ক্ষেত্রে উন্মুক্ত বিচার প্রক্রিয়া গণমাধ্যম বা জনসাধারণের মধ্যে অযাচিত প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার গুরুত্বপূর্ণ।
  • ৫। নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: যদি কোনো বিচারিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের জীবনের প্রতি হুমকি থাকে, তবে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।
  • ৬। কিশোর অপরাধ এবং পারিবারিক বিরোধ: পারিবারিক কলহ বা কিশোর অপরাধের বিচারগুলোতে রুদ্ধদ্বার বিচারিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয় যাতে সংবেদনশীল তথ্য গোপন রাখা যায় এবং ভুক্তভোগীদের সামাজিক মর্যাদা রক্ষিত হয়।

 

রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচারের আন্তর্জাতিক উদাহরণ

  • ১। যুক্তরাজ্য: যুক্তরাজ্যে পারিবারিক ও শিশুদের সংক্রান্ত মামলাগুলোতে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। বিশেষ করে শিশু অধিকার ও তাদের নিরাপত্তা রক্ষার্থে আদালত রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচারকার্য পরিচালনা করে। উদাহরণস্বরূপ, হাই-প্রোফাইল বিবাহ বিচ্ছেদ বা শিশু অধিকার সংক্রান্ত মামলাগুলোতে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়।
  • ২। যুক্তরাষ্ট্র: যুক্তরাষ্ট্রে গোপনীয়তা রক্ষার জন্য রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার বেশ প্রচলিত। বিশেষত যৌন হয়রানি, শিশু নির্যাতন, এবং জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত মামলাগুলোতে এই প্রক্রিয়া ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ম্যানহাটন শিশু নির্যাতন মামলা যেখানে শিশুদের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য আদালত সমস্ত প্রক্রিয়া রুদ্ধদ্বার কক্ষে পরিচালিত করে।
  • ৩। ফ্রান্স: ফ্রান্সে গুরুতর নিরাপত্তা সম্পর্কিত মামলাগুলোতে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার করা হয়। ফ্রান্সে সন্ত্রাসী মামলাগুলোর বিচার রুদ্ধদ্বার কক্ষে সম্পন্ন করার প্রচলন রয়েছে, যেখানে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে জনসমক্ষে বিচার নিষিদ্ধ করা হয়। 

রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচারের ইতিহাস

রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচারের প্রক্রিয়ার ইতিহাস দীর্ঘ এবং প্রাচীন। প্রাচীনকাল থেকেই কিছু ক্ষেত্রে গোপনীয়তার স্বার্থে বিচারপ্রক্রিয়া জনসাধারণের থেকে দূরে রাখা হতো। বিভিন্ন দেশের বিচারিক ব্যবস্থায় যুগ যুগ ধরে এই পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে।

যুক্তরাজ্য: যুক্তরাজ্যে রুদ্ধদ্বার বিচারের ব্যবহার দীর্ঘদিনের। যেমন, ১৯৭০ সালে সংঘটিত একাধিক গোপনীয় মামলায় এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছিল, যেখানে জাতীয় নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার স্বার্থে মামলাগুলো জনসম্মুখে উন্মুক্ত রাখা হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্র: যুক্তরাষ্ট্রে রুদ্ধদ্বার বিচারের ব্যবহার হয় জাতীয় নিরাপত্তা, ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা, এবং যৌন অপরাধ সংক্রান্ত মামলাগুলোর ক্ষেত্রে। বিশেষ করে FBI বা CIA-র মতো গোপন সংস্থার কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে জনসাধারণের অংশগ্রহণ না থাকাই বাঞ্ছনীয়।

ভারত: ভারতেও রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার প্রক্রিয়া প্রচলিত। ভারতের বিচারব্যবস্থায় বিশেষত পারিবারিক আদালত, কিশোর আদালত ও যৌন নির্যাতন মামলায় রুদ্ধদ্বার বিচার প্রয়োগ করা হয়।

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রুদ্ধদ্বার বিচার

বাংলাদেশের আইনে বিশেষ কিছু মামলায় রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচারের বিধান রয়েছে। যেমন, বাংলাদেশে “পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩” অনুযায়ী পারিবারিক বিষয়ক মামলাগুলোতে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার করা যেতে পারে।

পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩-এর ১২ ধারায় রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচারিক প্রক্রিয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছেঃ 

  • ১২(১) ধারা অনুসারে, পারিবারিক আদালত বা আপিল আদালত উপযুক্ত মনে করিলে মামলার সম্পূর্ণ বা আংশিক কার্যধারা রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠান করতে পারবে।
  • ১২(২) ধারা অনুযায়ী, উভয় পক্ষের সম্মতিতে রুদ্ধদ্বার বিচার অনুষ্ঠান করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এটি সাধারণত পারিবারিক বিরোধ বা এমন কোন মামলা যেখানে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করা প্রয়োজন, সেখানে প্রযোজ্য।

উদাহরণ: বাংলাদেশে পারিবারিক বিরোধের ক্ষেত্রে, যেমন বিবাহ বিচ্ছেদ, সন্তান পালনের অধিকার বা স্ত্রীর উপর নির্যাতনের মামলাগুলোতে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার করা হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ধর্ষণ মামলায় ভুক্তভোগী নারী বা শিশুর নিরাপত্তা ও মানসিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য রুদ্ধদ্বার বিচার অনুষ্ঠিত হতে পারে।

রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার হলো এমন একটি বিচারিক পদ্ধতি যেখানে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, নিরাপত্তা, এবং সামাজিক স্বার্থ রক্ষার জন্য উন্মুক্ত বিচারিক প্রক্রিয়াকে সংক্ষিপ্ত করে রুদ্ধদ্বার কক্ষে আলোচনা করা হয়। বাংলাদেশের পারিবারিক আদালত আইন এবং অন্যান্য বিচারিক বিধানে এই পদ্ধতির উল্লেখ রয়েছে, যা গোপনীয়তার সংবেদনশীলতা ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.