হানি ট্র্যাপ-মানি ট্র্যাপ: ভিকটিমের করনীয় কি?

বিবিধ আইন

স্কুলে আমরা রচনা লিখতাম, বিজ্ঞান অভিশাপ নাকি আশীর্বাদ। তখন আমরা মুখস্ত লিখতাম অভিশাপ এবং আশীর্বাদ নিয়ে কিন্তু এখন উপলব্ধি করি যে বিজ্ঞান আসলে একটা টুল। এটি যে যেভাবে ব্যবহার করবে, সেভাবেই আমাদের কাছে দৃশ্যমান হবে। এখন অনলাইনে আমি যেমন সার্চ করে আইন জানতে এই আর্টিকেলটি পড়তে পারছেন, ঠিক একইভাবে কেউ না কেউ এখন সার্চ বোমা বানানো শিখছে বা অশ্লীল জিনিস দেখছি। এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি এটাকে কীভাবে ব্যবহার করবে, তার উপর।

ডিজিটাল যুগে আমাদের জীবনযাত্রা যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি অনলাইন প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মতো অপরাধের ঝুঁকিও বেড়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো “হানি ট্র্যাপ” ও “মানি ট্র্যাপ”। এসব অপরাধের শিকার হয়ে অনেক সম্মানিত ব্যক্তি আর্থিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। একজন আইনজীবী হিসেবে কোর্টকাছারিতে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা এবং খবরের কাগজে অভিনব উপায়ে মানুষকে টার্গেট করার যেসব ঘটনা ঘটছে বলে জানতে পারছি, সেগুলো নিয়ে আজকের আর্টিকেলটা লিখতে বসলাম। শুরুতেই কিছু ঘটনা শুনুনঃ

সোহেল রানা, ৪৫ বছর বয়সী একজন ব্যাংক কর্মকর্তা, পেশাগত জীবনে অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন। ফেসবুকে “তানিয়া” নামের এক তরুণীর সাথে তার পরিচয় হয়। কয়েক মাসের নিয়মিত কথাবার্তার মাধ্যমে সম্পর্ক গাঢ় হয়। একদিন তানিয়া ভিডিও কলে এসে কিছু ব্যক্তিগত মুহূর্ত ক্যাপচার করে রাখে এবং পরে তা প্রকাশ করার হুমকি দিয়ে ৩০ লাখ টাকা দাবি করে।  

কানাডাপ্রবাসী ব্যবসায়ী কামাল হোসেন (বয়স ৫০) অনলাইনে ‘লাভলি প্রিয়া’ নামে এক তরুণীর সাথে পরিচিত হন। কয়েক মাস কথাবার্তা চলার পর ‘প্রিয়া’ নিজেকে বাংলাদেশে আটকে পড়া প্রেমিকা হিসেবে পরিচয় দেয়। ভিসা ফি, বিমান টিকিট ও অন্যান্য খরচের নামে কামালের কাছ থেকে প্রায় ৫ লাখ টাকা আদায় করা হয়। যখন তিনি বুঝতে পারেন সবই প্রতারণা, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।  

৪৮ বছর বয়সী উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা আফরোজা সুলতানা লিঙ্কডইন প্রোফাইলে এক ভদ্র চেহারার ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করেন, যিনি নিজেকে মালয়েশিয়ার এক ইঞ্জিনিয়ার পরিচয় দেন। ব্যক্তিগত মেসেজিংয়ে কিছু সংবেদনশীল তথ্য শেয়ার করার পর আফরোজাকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়। ভয় এবং লজ্জার কারণে প্রথমে তিনি বিষয়টি চাপা রাখেন, কিন্তু পরে তার অফিসে কিছু স্ক্রিনশট ছড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে আফরোজা সুলতানার ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং কর্মজীবনের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন হয়।

৪৫ বছর বয়সী ডা. শহিদুল ইসলাম, একদিন ইনস্টাগ্রামে ‘ডান্সিং ডিভা’ নামে এক তরুণীর মেসেজ পান। কথাবার্তা জমতে জমতে মেয়েটি এক সময় ভিডিও চ্যাট করতে চায়। সরল বিশ্বাসে রাজি হয়ে গেলে মেয়েটি তার ব্যক্তিগত মুহূর্ত রেকর্ড করে রাখে। পরে সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। ডা. শহিদুলের হার্ট অ্যাটাক করার মত অবস্থা। 

২৯ বছর বয়সী তরুণ ইঞ্জিনিয়ার নাসির উদ্দিন “বিশ্ব ভালোবাসা দিবস” উপলক্ষে একটি ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার শুরু করেন। সেখানে “সিমরান” নামে এক বিদেশী তরুণীর সাথে তার পরিচয় হয়। সিমরান প্রেমের অভিনয় করে ভিসা ও টিকিটের জন্য একাধিকবার অর্থ পাঠানোর অনুরোধ করে। ভালোবাসার আশায় নাসির প্রায় ২ লাখ টাকা পাঠান। পরে জানতে পারেন ছবিগুলোও নকল এবং পুরো পরিচয়ই ভুয়া। 

নামগুলো ছদ্মনাম কিন্তু এই ধরনের ঘটনা কানপাতলে আপনিও শুনতে পারবেন। এখন হাতের মোবাইলটা দিয়ে মানুষ খুচরো সুড়সুড়ি/বিনোদনের লোভে নিজের কত বড় যে বিপদ ডেকে আনতে পারে, সেটা না শুনলে বিশ্বাসই করতে পারবেন না। হবেই বা না কেন, বর্তমান যুগে মানুষ অফলাইনের চেয়ে অনলাইনে বেশী সময় কাটায়। আগে মানুষ প্রেম, ভালোবাসা হতো পাশের বাসা, পাশের বাড়ি, অফিসের কলিগ, ক্লাসমেটের সাথে। আর এখন প্রেম হচ্ছে কয়েক হাজার মাইল দূরের কোন মানুষের সাথে, আর মাধ্যম হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম গুলো। কিন্তু, এই প্রেম ভালোবাসার মধ্যেও রয়েছে সুবিধাবাদী চক্র, যারা মানুষের আবেগ আর গোপনীয়তাকে পুঁজি করে মোটা অংকের অর্থ কামিয়ে নেয়। অনেকেই না বুঝে এই ফাঁদে পা দেয় এবং সেই অনুযায়ী নিজের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, কর্মজীবনে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। অনেকেই আছেন হয়ত নিজে এই কুচক্রের ফাঁদে পা দিয়েছেন, কেউ এমনও দেখেছি তাকে জোর করে কুচক্রের ফাঁদে ফেলা হয়েছে। আর একমাত্র কারন হচ্ছে অসচেতনতা। ব্যক্তিগত সচেতনতা, পারিবারিক সচেতনতা, ধর্মীয় এবং সামাজিক সচেতনতা থাকলে এমন কুচক্রের ফাঁদে পড়ার কথা না আর ফাঁদে পড়লেও অর্থ, সম্মান এবং কখনো কখনো জীবন বিপন্ন করা লাগতো না। তাই, চলুন সচেতনতা বাড়াই এবং এই কুচক্রের চক্রান্ত থেকে নিজে বাঁচি, অন্যদেরকেও বাঁচাই।

প্রথমত, সামাজিক মাধ্যমে প্রোফাইল তৈরি করার সময় এবং অপরিচিতদের সাথে যোগাযোগের সময় নিজের ব্যক্তিগত তথ্য, যেমন – ঠিকানা, ফোন নম্বর, পেশা, আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি খুব সতর্কতার সাথে শেয়ার করুন।

দ্বিতীয়ত, অপরিচিত বা অল্প পরিচিত কারো সাথে ভিডিও কলে কোনো ব্যক্তিগত বা আপত্তিকর কার্যকলাপ করবেন না। মনে রাখবেন, স্ক্রিনশট বা ভিডিও রেকর্ডিং খুব সহজেই করা যায় এবং এটি আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে।

তৃতীয়ত, অনলাইনে কারো অনুরোধে বা প্রলোভনে কোনো প্রকার আর্থিক লেনদেন করবেন না, বিশেষ করে যদি আপনি সেই ব্যক্তিকে ব্যক্তিগতভাবে না চেনেন। ভিসা ফি, বিমান টিকিট বা অন্য কোনো অজুহাতে টাকা চাওয়া হলে তা ভালোভাবে যাচাই করুন।

চতুর্থত, অনলাইনে খুব আকর্ষণীয় বা অস্বাভাবিক প্রস্তাব পেলে সন্দেহ করুন। “সহজেই ধনী হওয়া” বা “অবাস্তব প্রেমের প্রস্তাব” প্রায়শই ফাঁদ হতে পারে। তাছাড়া, যদি আপনি কোনো সন্দেহজনক প্রোফাইল বা কার্যকলাপ দেখতে পান, তবে সংশ্লিষ্ট প্ল্যাটফর্মে রিপোর্ট করুন। আপনার একটি ছোট্ট পদক্ষেপ হয়তো অন্য অনেককে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে পারে।

পঞ্চমত, আপনার সামাজিক মাধ্যম এবং অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্টের শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন এবং নিয়মিত তা পরিবর্তন করুন। আপনার ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও কারা দেখতে পারবে তা নিয়ন্ত্রণ করুন। তাছাড়া, ইন্টারনেট এবং সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের নিয়মকানুন ও নিরাপত্তা সম্পর্কে জ্ঞান রাখুন। বিভিন্ন ধরনের অনলাইন প্রতারণা সম্পর্কে অবগত থাকুন। 

ষষ্ঠত, অনলাইনে কোনো অস্বাভাবিক সম্পর্ক বা প্রস্তাবের সম্মুখীন হলে নিজের ভিতরে চাপিয়ে রেখে মানসিক স্ট্রেসে নিজেকে নিজে ধ্বংস না করে বিশ্বস্ত বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সাথে আলোচনা করুন। তাদের পরামর্শ আপনার ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বাঁচাতে পারে। পাশাপাশি, প্রয়োজনে কোথায় এবং কীভাবে আইনি সহায়তা পাওয়া যায় সে সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা রাখুন। আপনার এলাকার থানা, সাইবার ক্রাইম ইউনিট এবং আইনি পরামর্শ কেন্দ্রের ঠিকানা ও ফোন নম্বর জেনে রাখতে পারেন।

পরিশেষে বলা যায়, সচেতনতা এবং সতর্কতা অবলম্বন করার পাশাপাশি আইনি প্রতিকারের সুযোগ সম্পর্কে অবগত থাকা এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহায়ক হতে পারে। কোনো প্রকার ব্ল্যাকমেইলিং বা হয়রানির শিকার হলে দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য।‘হানি ট্র্যাপ-মানি ট্র্যাপ’ সংক্রান্ত সমস্যাগুলো ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি বিভিন্ন লেভেলের হতে পারে, তাই স্পেসিফিক কোন আইনের অধীন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, এটা আগে থেকে বলা অনিশ্চিত। কিন্তু, এই ধরনের সমস্যাগুলো কোর্টকাছারিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০, দণ্ডবিধি ১৮৬০, ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮, দেওয়ানী কার্যবিধি ১৯০৮ সহ যাবতীয় আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। হতাশ হবেন না, ভয়ে চুপসে যাবেন না, আপনি হয়ত ভুল করেছেন, কিন্তু যারা আপনার ব্ল্যাকমেইল করে যাচ্ছে, তারা অন্যায় করে যাচ্ছে। আইন আপনার পাশে আছে, আপনাকে শুধু সাহস করে আইনের আশ্রয় নিতে হবে। আপনি নিয়মিত লিখে যাবো জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে, আপনারাও আমাদেরকে সহযোগিতা করতে পারেন এই ধরনের তথ্য উপাত্ত দিয়ে। ধন্যবাদ। 

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.