ভদ্রলোকের এক কথা, সকালেও যা, বিকেলেও তা। আমি আপনি যতই অভদ্র হই না কেন, আইন কিন্তু সবসময় আমাদেরকে ভদ্র লোক হিসেবেই মূল্যায়ন করে। যার ফলে, আমি আপনি কারো সাথে কোন কথা দেওয়ার সময় বা চুক্তি করার সময় আজকে যা বলবো, আমাদের সেই কথার মধ্যেই অটল থাকতে হবে। আমরা যদি সকালে এক কথা বলি আর বিকেলে আরেক কথা বলি, আর সকালের কথার সাথে যদি বিকেলের কথা পরস্পর বিরোধী হয়, তাহলে মানুষ আমাদেরকে কি বলবে?- নিশ্চয়ই ভালো কিছু বলবেন না।
আমরা যেহেতু নিজের প্রথম বক্তব্য নিজে বিশ্বাস করে এবং অন্যকে বিশ্বাস করিয়ে কোন একটি কাজ করিয়ে/না করিয়ে/ঘোষণা দিয়ে পরবর্তীতে নিজের বক্তব্য নিজেই অস্বীকার করছি, তখন অপর পক্ষের ব্যক্তিটি কিন্তু আমাদের বক্তব্য বিশ্বাস করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেননা, ঐ ব্যক্তি আমাদের প্রথম বক্তব্য বিশ্বাস করে যে সিদ্ধান্ত বা কার্য সম্পাদন করেছে, আর এখন আমরা বক্তব্য বা অবস্থান পরিবর্তন করার কারনে ঐ ব্যক্তি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বা হতে পারে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে কেউ যাতে না পড়ে বা কেউ যাতে সময়ের সাথে সাথে বক্তব্য পরিবর্তন করার সুযোগ না পায়, তাই প্রতিষ্ঠা করা হয় Estoppel নীতি যার বাংলা অর্থ ‘স্বকার্যজনিত বাধা’।
‘Estoppel (এস্টপেল) বা স্বকার্যজনিত বাধা’ শব্দটি একটি আইনি নীতিকে বোঝায় যা কাউকে কিছু অস্বীকার করতে বা এমন একটি অধিকার জাহির করতে বাধা প্রদান করে যা কিনা তারা পূর্বে বলেছিল বা আইন দ্বারা সম্মত হয়েছিল কিন্তু বর্তমানে পূর্বের কর্মের বিরোধিতা করছে। সহজ ভাষায় বললে, Estoppel (এস্টপেল) বা স্বকার্যজনিত বাধা একজন ব্যক্তিকে অতীতের কোনো কর্ম বা বিবৃতিকে বিরোধিতা করতে বাধা দেয়। এটি সাধারণ আইনের অংশ এবং অন্য ব্যক্তির কথা বা কাজের অসঙ্গতি দ্বারা মানুষকে অন্যায়ভাবে অবিচার করা থেকে বিরত রাখার জন্য।
সাক্ষ্য আইনের ১১৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, ‘যখন কোন ব্যক্তি তার ঘোষণা (declaration), কাজ (act) বা কার্য বিরতি (omission)’র দ্বারা ইচ্ছাকৃত ভাবে অন্য ব্যক্তিকে কোন বিষয়কে সত্য বলে বিশ্বাস করায় এবং সেই বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করতে বলে, তখন উক্ত ২ পক্ষের মধ্যে কোন মামলায় ১ম পক্ষ তার ঘোষণা (declaration), কাজ (act) বা কার্য বিরতি (omission)’র বিষয়টি অস্বীকার করতে পারবে না।’
Estoppel (এস্টপেল) বা স্বকার্যজনিত বাধার প্রকারভেদ
বিভিন্ন ধরনের Estoppel (এস্টপেল) বা স্বকার্যজনিত বাধা রয়েছে। আইনি অঙ্গনে পাওয়া সবচেয়ে সাধারণ কিছু নিম্নলিখিত আছেঃ
- Equitable Estoppel/ইক্যুইটেবল এস্টপেল: Equitable Estoppel/ইক্যুইটেবল এস্টোপেল কাউকে আইনি অবস্থান নিতে বাধা দেয় যা তাদের পূর্বের অবস্থানের বিপরীত বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ, যা কিনা অন্য পক্ষের ক্ষতি করে থাকে। আপনি যখন নিজেই নিজের পূর্বের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটিয়ে অন্যের ক্ষতি করছেন, তখন আপনাকে আইনি অবস্থান নিতে Equitable Estoppel/ইক্যুইটেবল এস্টোপেল বাধা প্রদান করে।
- Promissory Estoppel/প্রমিসরি এস্টপেল: Promissory Estoppel সাধারণত চুক্তি আইনে পাওয়া যায়। প্রমিসরি এস্টপেল এমন একজন ব্যক্তিকে রক্ষা করে, যিনি অন্য ব্যক্তির যুক্তিসঙ্গত প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে কাজ করেছেন, তা আনুষ্ঠানিক চুক্তিতে হোক বা না হোক, এবং তারপরে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, কারণ অন্য পক্ষ সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। অর্থাৎ, আপনি কারো সাথে একটি চুক্তি করেছেন কোন কিছু ক্রয় করার জন্য এবং আপনি চুক্তিতে আপনার অংশ সম্পন্ন করেছেন, কিন্তু অন্য পক্ষ প্রতিশ্রুতি অনুসারে কাজ করেনি, তখন Promissory Estoppel আপনাকে রক্ষা করবে যাতে ঐ লোক তার প্রতিশ্রুতি পূরণে বাধ্য হয়।
- Collateral Estoppel/সমান্তরাল এস্টপেল: একটি Collateral Estoppel/সমান্তরাল এস্টপেল একজন ব্যক্তিকে একই অভিযোগের সাথে বাদী হিসাবে আদালতে ফিরে যেতে বাধা দিতে পারে। এটি আইনি হয়রানি এবং আইনি সম্পদের অপব্যবহার প্রতিরোধ করে। কিছু লোক আছে মামলাবাজ, এদের কাজ হচ্ছে শুধু মামলা করে করে অন্যদের হয়রানি করা। সবসময় তো আর নতুন নতুন ইস্যু পাওয়া যায় না, তাই কিছু মামলাবাজ আছে তারা একই অভিযোগে বারংবার মামলা করে থাকে। এই ধরনের মামলাবাজদেরকে ঠেকানোর জন্য Collateral Estoppel/সমান্তরাল এস্টপেল নীতি প্রয়োগ করা হয়।
- Estoppel by Deed/চুক্তি থেকে সৃষ্ট এস্টপেল: Estoppel by Deed/চুক্তি থেকে সৃষ্ট এস্টপেল একজন ব্যক্তিকে তাদের সম্পাদিত একটি চুক্তিতে বর্ণিত যেকোন সত্যের সত্যতা অস্বীকার করতে বাধা দেয়। আপনি যখন কারো সাথে চুক্তি করবেন, তখন চুক্তিতেই উল্লেখ করে দিবেন যাতে কেউই চুক্তিতে বর্ণিত যেকোন সত্যের সত্যতা অস্বীকার করতে না পারে।
- Estoppel by representation/প্রতিনিধিত্ব দ্বারা এস্টপেল: Estoppel by representation/ প্রতিনিধিত্ব দ্বারা এস্টপেল সাধারণত, একটি দলকে পরবর্তীতে একটি নতুন বিরোধী অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করে পূর্ববর্তী ভুল উপস্থাপনাকে বিরোধিতা করতে বাধা দেওয়ার জন্য বিদ্যমান।
এর বাহিরেও আরও বিভিন্ন নামে Estoppel (এস্টপেল) বা স্বকার্যজনিত বাধার কয়েকটি প্রকারভেদ রয়েছে যা উপরের ৫ টি প্রকারভেদেরই শাখা প্রশাখা।
Estoppel (এস্টপেল) বা স্বকার্যজনিত বাধার প্রয়োগঃ
Estoppel (এস্টপেল) বা স্বকার্যজনিত বাধা সাক্ষ্য আইনের একটি নীতি যা কিনা শুধু মাত্র দেওয়ানী কার্যক্রমে প্রয়োগ করা হয়। ফৌজদারি কার্যক্রমে Estoppel (এস্টপেল) বা স্বকার্যজনিত বাধার কোন ব্যবহার নেই। তবে, হয়ত ভবিষ্যতে ফৌজদারি আইনেও এর প্রভাব দেখা যাবে, কেননা আমেরিকাতে ইতিমধ্যে ‘ফাঁদে ফেলে এস্টপেল’ নামে একটি নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ফৌজদারি কার্যক্রমের পাশাপাশি আইনসভায় যেসব আইন বা বিধি প্রণয়ন করা হয়, তাদের বিরুদ্ধেও Estoppel (এস্টপেল) বা স্বকার্যজনিত বাধা প্রয়োগ হবে না।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )