তামাদি আইন

তামাদি মেয়াদ গণনা পদ্ধতিঃ পর্ব ০৩

তামাদি আইন বিবিধ আইন

তামাদি মেয়াদ গণনার যে রীতিনীতিগুলো রয়েছে, সেগুলো গত দুই পর্বে যা আলোচনা করা হয়েছে, তার বাকী অংশ আলোচনা করতে এই অনুচ্ছেদে আমরা প্রতারণা, লিখিত প্রাপ্তি স্বীকার, অক্ষম ব্যক্তির প্রতিনিধি ইত্যাদি নিয়ে যাবতীয় রীতিনীতিসমূহ বর্ণনার চেষ্টা করবো। বর্ণনা নিম্নরূপ:-

৮। আপনাকে আপনার অধিকার সম্বন্ধে যদি অবহিত করা না হয় প্রতারণার মাধ্যমে, তাহলে আপনি আপনার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, আপনি নিজ থেকে আপনার অধিকার সম্বন্ধে উদাসীন হলে সেটা ভিন্ন কথা। তবে আপনাকে মামলা দায়ের বা দরখাস্ত দাখিল করার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সেই অধিকার সম্বন্ধে প্রতারণার মাধ্যমে আপনাকে জানতে দেওয়া না হয় বা কোন দলিল গোপন করে রাখা হয়, তাহলে আপনি প্রতারণার জন্য দোষী ব্যক্তি বা তার সহযোগীর বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম জানতে পারবেন, সেদিন হতে মামলা দায়ের বা দরখাস্ত দাখিলের জন্য নির্ধারিত তামাদির মেয়াদ গণনা শুরু করতে হবে। আবার, যদি কেউ আপনার বিরুদ্ধে কোন দলিল গোপন করে রাখা হয় যার ফলে আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, সেই ক্ষেত্রে আপনি যেদিন দলিলটি উপস্থাপন করতে পারবেন বা অপর পক্ষকে উক্ত দলিলটি উপস্থাপন করতে, সেদিন থেকে মামলা দায়ের বা দরখাস্ত দাখিলের জন্য আপনার তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হবে।

এখন কথা হচ্ছে, এই সুযোগ কি সবার জন্য? না। শুধুমাত্র যারা প্রতারণার স্বীকার হবেন তাদের অধিকার সম্বন্ধে বা দলিল গোপন করে রাখা হবে যাদের। এখানে ‘সরল বিশ্বাস’ কিন্তু অনেক শক্তিশালী শব্দ হিসাবে শনাক্ত হবে। কেননা, আপনি জানেন যে আপনার সাথে প্রতারণা করা হয়েছে কিন্তু জেনেও না জানার মত করে বসে থাকলে চলবে না। আপনি সরল বিশ্বাসে যদি কাউকে বিশ্বাস করেন এবং সেই বিশ্বাসের বশে কেউ আপনার সাথে প্রতারণা করে, যা আপনি জানতেন, তখন কিন্তু তামাদির মেয়াদ গণনা শুরু হবে না। আপনি যখন থেকে প্রতারণা সম্বন্ধে অবগত হবেন, তখন থেকেই তামাদির মেয়াদ গণনা শুরু হবে। আর, দলিল গোপনের বিষয় নিয়েও আপনার সরল বিশ্বাসের প্রয়োজন রয়েছে। আপনি দলিল নিজের কাছে গোপন রেখে নাটক করলে কিন্তু হবে না। দলিল পাওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা আপনাকে করতে হবে। তারপরও যখন পাবেন না, তখন গিয়ে আপনি তামাদির এই সুযোগটি পাবেন। আর এই সুযোগটি তামাদির আইনের সবচেয়ে বড় সুযোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। কেননা, ৫০ ডি এল আর (এডি) ৫০ মামলার রায়ে বলা হয়েছে যে, প্রতারণার মাধ্যমে কোন দলিল কেউ প্রাপ্ত হলে, সেই দলিল সম্পর্কিত মামলার তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হবে যে দিন ঐ প্রতারণা সম্বন্ধে জানা যাবে, ঐ দিন থেকে নয় যেদিন দলিলটি কার্যকর হয়েছে। উল্লেখ্য, মামলাটি হয়েছিল, হাসনা বানু এবং অন্যান্য বনাম কেয়ামত উল্যাহ এবং অন্যান্য এর মধ্যে। আবার, আবুল খায়ের মিয়া বনাম আবদুল লতিফ সর্দার (১৯৮০) ৩২ ডি এল আর ১৬৭ মামলার রায়ে বলা হয়েছে যে, প্রতারণা হয়েছে এটা প্রমাণিত হয়, তাহলে তামাদির কোন প্রশ্নই উঠবে না। যেদিন প্রতারণা শনাক্ত হয়েছে সেদিন থেকে তামাদির মেয়াদ গণনা শুরু হবে।


অতএব, আপনার সাথে প্রতারণা হলে তামাদির মেয়াদ থেকে আপনি সুবিধা পাবেন অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য মামলা দায়ের বা দরখাস্ত দাখিলের মাধ্যমে।

৯। আপনি যদি আপনার কোন বন্ধুর কাছ থেকে বা পরিচিত আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে টাকা পয়সা ঋণ বা ধার নিয়ে থাকেন, তখন একটা সময়সীমা নিশ্চয়ই উল্লেখ থাকে। বাহিরের দেশে যদিও এই ধরণের লেনদেনে কাগজপত্রের রীতি রয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশে বড় অংকের টাকার লেনদেন ব্যতীত লেখালেখি হয় না সাধারণত। যদিও ধর্মেও উল্লেখ রয়েছে টাকা পয়সার লেনদেনে সাক্ষী বা লেখালেখির বিষয়টি। যাই হোক, লিখিত হোক বা মৌখিক, যখনি একটি সময়সীমা উল্লেখের কথা থাকে, তখন ঐ সময়ের মধ্যে পাওনা পরিশোধ হলে তো কোন সমস্যা নাই। কিন্তু বিপত্তি ঘটবে তখন যখন আপনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপনার বন্ধু বা আত্মীয় স্বজনের পাওনা টাকা পরিশোধ করবেন না। সময়সীমার মধ্যে পরিশোধ না করলে সময়সীমা অতিক্রম হওয়ার পরপরই তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হবে তখন যদি আপনি গিয়ে আপনার পাওনাদারকে লিখিতভাবে আপনার দায় স্বীকার করেন, তাহলে যেদিন লিখিত দায় স্বীকার করেছেন, সেদিন থকে পুনরায় নতুন করে তামাদির মেয়াদ গণনা শুরু হবে। এটা কিন্তু পাওনাদারের পক্ষে যাচ্ছে। আগে যেখানে পাওনাদার টাকা পরিশোধের নির্ধারিত তারিখের শেষ দিনের পরের দিন থেকে তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু করার কথা, সেখানে আপনি লিখিত প্রাপ্তি স্বীকার করার কারণে নতুন করে তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হবে। যার ফলে তামাদি মেয়াদ পাওনাদারের জন্য বেড়ে গেলো এবং আপনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার জন্যও তার সময় বেড়ে গেলো। তবে, মনে রাখতে হবে যে, দায় স্বীকার অবশ্যই নিঃশর্তমূলক হতে হবে। আর নিঃশর্ত দায় স্বীকারোক্তি প্রদানের তারিখ হতেই তামাদির মেয়াদ গণনা শুরু হবে। এখানে উল্লেখ্য, এই দায় স্বীকার করার বিষয়টি কোন সম্পত্তি বা অধিকার সম্পর্কে মামলা দায়ের বা দরখাস্ত দাখিল করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। আর, ‘স্বাক্ষরিত’ এই শব্দ দ্বারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি স্বয়ং বা এই ব্যাপারে স্বয়ং ঐ ব্যক্তি থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি দ্বারা স্বাক্ষরিত বুঝাবে। বলা বাহুল্য, এই দায় স্বীকার অবশ্যই তামাদির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে হতে হবে। কেননা, তামাদির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে, পাওনাদার মামলা দায়ের বা দরখাস্ত দাখিলের অধিকার হারাবে।

আরো উল্লেখ্য, কোন ডিক্রি জারী বা আদেশ কার্যকরী করার দরখাস্ত একটি অধিকার সম্পর্কিত দরখাস্ত বলে গণ্য হবে।
অক্ষম ব্যক্তির প্রতিনিধি সহ বাকী পয়েন্টগুলো নিয়ে পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা হবে। আজ এখানেই সমাপ্ত।

 

[ বাকি পর্বগুলোঃ পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৪  ]

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.