ডেইলি স্টারের ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের ৮ তারিখের একটি আর্টিকেল অনুসারে, পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের ১৬২ টি দেশে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ প্রবাসী হিসেবে বসবাস করছে যা কিনা মাইগ্রেন্টের দিক থেকে পৃথিবীতে ষষ্ঠ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বসবাস মধ্য প্রাচ্যে। আমরা জানি, মধ্য প্রাচ্যে বিবাহের সুযোগ না থাকলেও ইউরোপ, আমেরিকাসহ পৃথিবীর বাকি দেশ গুলোতে পড়াশোনা বা কাজের জন্য গিয়ে অনেকেই বিবাহ করে থাকে। আর বিবাহের ক্ষেত্রে আগে অনেকেই বেশ প্রতারণা করে থাকতো, যেমন দেশে বউ বাচ্চা থাকা সত্ত্বেও তা গোপন করে প্রবাসে পুনরায় বিবাহ করতো। এতে দেশের পরিবার যেমন কিছুই জানতে পারতো না, তেমনি ভিন দেশী ঐ মানুষটিও না জেনে প্রতারিত হতো। তাই, ক্রমেই এখন প্রবাসে বিয়ে করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের মধ্যে অবিবাহিত সনদ বা Single Status Certificate বা Unmarried Certificate বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। আজকে আমরা জানবো, অবিবাহিত সনদ বা Single Status Certificate/Unmarried Certificate কি, কেন, কিভাবে?
মুসলিম আইন অনুসারে একই সময়ে একাধিক স্ত্রী রাখা যায় তবে কোন মতেই চারের অধিক নয়, আবার কিছু কিছু সমাজে একই সাথে একাধিক স্বামী রাখা যায়। কিন্তু, ক্রমেই বিভিন্ন রাষ্ট্রে একই সময়ে একাধিক স্ত্রী বা একাধিক স্বামী রাখার রীতি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং এর নিশ্চয়তার জন্য বিবাহের সময় আপনি যে অবিবাহিত সেটি নিশ্চিত করার জন্য যে সনদ বা সার্টিফিকেট প্রদানের মাধ্যমে নিজেকে অবিবাহিত প্রমাণ করা হয়, তার নামই হচ্ছে অবিবাহিত সনদ বা Single Status Certificate বা Unmarried Certificate; দেশ থেকে বিদেশে গিয়ে বিয়ের ক্ষেত্রে এখন এই সনদকে শর্ত হিসেবে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া, সামরিক চাকরীর ন্যায় বিভিন্ন পদে যোগদান করার ক্ষেত্রেও এখন অবিবাহিত সনদ বা Single Status Certificate বা Unmarried Certificate বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী, স্বামী বা স্ত্রীর জীবদ্দশায় কেউ যদি পুনরায় বিবাহ করে তবে সেটি শাস্তি যোগ্য অপরাধ, যা কিনা যেকোনো বর্ণনার ৭ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে এবং জরিমানা দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। সেই অনুযায়ী, আমাদের দেশে বিয়ে নিয়ে যত প্রতারণা হয়ে থাকে এবং কাবিন বা বিবাহের রেজিস্ট্রি যেহেতু এখনো অনলাইন করা হয়নি, যার কারণে কেউ পূর্বে বিবাহ করেছে কিনা বা সেই বিবাহ এখনো বলবত রয়েছে কিনা সেটি যাচাই করার কোন সুযোগ নেই। তাই আমাদের দেশের বিবাহের ক্ষেত্রেও অবিবাহিত সনদ বা Single Status Certificate বা Unmarried Certificate বাধ্যতামূলক করা উচিত।
কোথায় আবেদন করতে হবে?
আপনি যদি প্রবাসী বাংলাদেশি হয়ে অবিবাহিত সনদ বা Single Status Certificate বা Unmarried Certificate এর জন্য আবেদন করেন, সেক্ষেত্রে আপনাকে আবেদন করতে হবে দূতাবাস বা এম্বাসি বা embassy বা হাইকমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের যে জেলায় আপনি বসবাস করেন, সেই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে, যাকে আমরা ডিসি/DC অফিস নামে জানি। দূতাবাস বা এম্বাসি বা embassy বা হাই কমিশন আবেদনটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পাঠায়। প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই শেষে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ব্যক্তির জন্য সত্যতা খুঁজে পেলে অবিবাহিত সনদ বা Single Status Certificate বা Unmarried Certificate ইস্যু করে এবং যাচাইকরণের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রক্রিয়াজাত করণের পর অবিবাহিত সনদ বা Single Status Certificate বা Unmarried Certificate হাই কমিশনে পাঠায়। দূতাবাস বা এম্বাসি বা embassy বা হাই কমিশন সত্যায়িত করে এবং আবেদনকারীর কাছে ফরোয়ার্ড করে। তাছাড়া, অবিবাহিত সনদ বা Single Status Certificate বা Unmarried Certificate সার্টিফিকেট বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসকের (ডিসি) অফিসের মাধ্যমেও পাওয়া যেতে পারে যদি প্রবাসী বাংলাদেশিদের পক্ষে কেউ বা তার আত্মীয়রা প্রয়োজনীয় ফি সহ সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদনপত্র জমা দিতে পারেন।
এ ছাড়া, সামরিক বাহিনীতে চাকরীর জন্য যে অবিবাহিত সনদ বা Single Status Certificate বা Unmarried Certificate লাগে, সেটি স্থানীয় সরকার অর্থাৎ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বা পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের কার্যালয় থেকেও সংগ্রহ করা যায়।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
(১) আপনি যদি অবিবাহিত সনদ বা Single Status Certificate বা Unmarried Certificate এর জন্য আবেদন করেন, সেক্ষেত্রে আপনার যেসব ডকুমেন্টস বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র লাগবে, সেগুলো হচ্ছে, আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট। অনেকের বয়স কমের কারণে ভোটার আইডি কার্ড না থাকলে জন্ম নিবন্ধন কার্ড নিয়েও আবেদন করা যাবে।
(২) যদি ইতিপূর্বে আপনি বিবাহ করে থাকেন এবং সেই বিবাহ তালাকের মাধ্যমে নিঃশেষ হয়ে থাকে, তবে সে ক্ষেত্রে তালাকের প্রমাণ স্বরূপ তালাক সার্টিফিকেট বা আদালতের ডিক্রি থাকলে সেই ডিক্রি প্রদর্শন করতে হবে।
(৩) যদি ইতিপূর্বে আপনি বিবাহ করে থাকেন এবং আপনার স্বামী বা স্ত্রী মৃত্যুবরণ করে, অর্থাৎ আপনি বিধবা বা বিপত্নীক হয়ে থাকলে, সেই ক্ষেত্রেও আপনি Single Status Certificate দিয়ে পুনরায় বিবাহ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে আপনার স্বামী/স্ত্রীর মৃত্যু সনদ প্রদর্শন করতে হবে।
তাছাড়া, আপনার ধর্ম পরিবর্তনের কারণে যদি আপনার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় বা আপনার নাম পরিবর্তন করিয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে আপনি সেগুলো প্রমাণ স্বরূপ কাগজপত্র গুলো সংগ্রহে রাখবেন।
তবে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য, যে দেশে আপনি আপনার এই অবিবাহিত সনদ বা Single Status Certificate বা Unmarried Certificate ব্যবহার করবেন, সেই দেশের যদি নির্দিষ্ট কোন ফরম্যাট বা শর্ত থাকে, সেই অনুসারেও আপনাকে নিজেকে অবিবাহিত/সিঙ্গেল প্রমাণ করতে হবে। তাই, আপনাকে বিদেশী কর্তৃপক্ষের দ্বারা বেঁধে দেওয়া নিয়মকানুন মেনে আপনার অবিবাহিত সনদ বা Single Status Certificate বা Unmarried Certificate প্রস্তুত করতে হবে।
অনেকেই খরচ সম্বন্ধে জানতে চায়, তাদের জন্য বলে রাখি, সরকারী খরচ ৭৫০ টাকা মাত্র যা কিনা আবেদনের ২/১ মাসের মধ্যেই পাওয়া সম্ভব। কিন্তু, বাস্তবে মাঠ পর্যায়ে কত খরচ হয় সেটি আসলে নির্ভর করে কার্যালয়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের উপর।
অবিবাহিত সনদপত্র
এই মর্মে প্রত্যয়নকরা যাইতেছে যে, ……….., পিতাঃ……….., মাতাঃ……….., গ্রামঃ……….., ডাকঘরঃ……….., ……….., উপজেলাঃ……….., জেলাঃ………..। সে আমার নিকট ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত। আমার জানামতে সে অবিবাহিত এবং উপরোক্ত ঠিকানার স্থায়ীবাসিন্দা ও বাংলাদেশের স্থায়ীনাগরিক।
আমি তাহার উজ্জল ভবিষ্যৎ কামনা করি। (চেয়ারম্যানের নাম) চেয়ারম্যান ……………… ইউনিয়ন পরিষদ উপজেলাঃ ………, জেলাঃ ……………।
|
অনুবাদ
আমাদের দেশে আপনাকে যে অবিবাহিত সনদ বা Single Status Certificate বা Unmarried Certificate দেওয়া হবে, সেটি সাধারণত বাংলাতে দেওয়া হবে। কিন্তু, আপনি যদি সেটি বিদেশে ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে আপনাকে সেটি ইংরেজিতে বা যদি কোন নির্দিষ্ট ভাষার উল্লেখ থাকে তাহলে সেই ভাষায় অনুবাদ করতে হবে। উক্ত পরিস্থিতিতে আপনাকে সেটি অনুবাদকের নিকট থেকে অনুবাদ করিয়ে নিতে হবে। কোথায় করবেন?- দেখবেন, বেশিরভাগ নোটারী পাবলিকের সাথে অনুবাদকও থাকে।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )