জামিন বাতিল হতে পারে যেসব কারনে

বিবিধ আইন

জামিন কেন দেওয়া হয় বা কেনই বা দেওয়া হয় না, সে বিষয়টি শুরুতেই বুঝতে হবে। জামিনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল আসামিকে বিচার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যবসায়ী যিনি একটি আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত, তিনি জামিনে থেকে তার ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন এবং একই সাথে বিচার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবেন। জামিন আসামির মৌলিক অধিকার রক্ষা করে। যেমন, একজন ছাত্র যিনি একটি রাজনৈতিক বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে গ্রেফতার হয়েছেন, তিনি জামিনে মুক্তি পেয়ে তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবেন। জামিন আসামিকে তার পরিবার ও সমাজের সাথে সংযুক্ত থাকার সুযোগ দেয়। যেমন, একজন গৃহবধূ  যিনি পারিবারিক কলহের কারণে অভিযুক্ত হয়েছেন, তিনি জামিনে থেকে তার সন্তানদের দেখাশোনা করতে পারবেন। জামিন আসামিকে তার পেশা বা ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন চিকিৎসক যিনি একটি চিকিৎসা সংক্রান্ত অভিযোগে অভিযুক্ত, তিনি জামিনে থেকে তার রোগীদের সেবা দিতে পারবেন।  জামিন আসামিকে তার আইনজীবীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে মামলার প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ দেয়। যেমন, একজন ব্যাংক কর্মকর্তা যিনি জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত, তিনি জামিনে থেকে প্রয়োজনীয় দলিল-দস্তাবেজ সংগ্রহ করে তার প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করতে পারবেন। জামিন ব্যবস্থা “নির্দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত দোষী নয়” এই নীতিকে সমর্থন করে। উদাহরণস্বরূপ, একজন রাজনৈতিক নেতা যিনি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত, তিনি জামিনে থেকে তার নির্দোষিতা প্রমাণের সুযোগ পাবেন। জামিন শুধুমাত্র আসামির উপস্থিতি নিশ্চিত করার একটি প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি আইনের শাসন, মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।

 

জামিনযোগ্য মামলায় জামিন পাওয়া অধিকার 

জামিনযোগ্য মামলায় জামিন পাওয়া একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার। মিয়া নুরুদ্দিন বনাম রাষ্ট্র মামলায় হাইকোর্টের রায় জামিনের নীতিকে আরও সুদৃঢ় করেছে এবং এটি ভবিষ্যৎ মামলাগুলোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির হিসেবে কাজ করবে। উক্ত রায় থেকে আমরা যা উপলব্ধি করতে পারি, তা হচ্ছে, জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে আসামির জামিন পাওয়ার অধিকার একটি মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচারের একটি অপরিহার্য অংশ।

ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে আদালত জামিন মঞ্জুর করতে বাধ্য। এটি আদালতের বিবেচনাধীন বিষয় নয়, বরং একটি আইনি বাধ্যবাধকতা। জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা অযথা হয়রানির শিকার হবেন না এবং তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ পাবেন। জামিন সকল নাগরিকের জন্য আইনের সমান প্রয়োগ নিশ্চিত করে। এটি নিশ্চিত করে যে জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত সকল ব্যক্তি একই ধরনের সুবিধা পাবেন। আদালতের দায়িত্ব হল জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন মঞ্জুর করা, তবে প্রয়োজনীয় শর্তারোপ করে তা নিশ্চিত করা যে আসামি বিচার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবেন। যদি কোনও আদালত অযৌক্তিকভাবে জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন নাকচ করে, তাহলে উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। 

 

জামিনঅযোগ্য মামলায় জামিন 

বাংলাদেশ সরকার বনাম শেখ হাসিনা, ২৮ বিএলডি (এডি) (২০০৮) ২৩৩ মামলায় প্রদত্ত রায়ে জামিনঅযোগ্য মামলায় জামিন নীতিকে আরও স্পষ্ট করেছে। এই রায় ভবিষ্যৎ মামলাগুলিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির হিসেবে কাজ করে। উক্ত রায় থেকে আমরা যেটা উপলব্ধি করতে পারি, তা হচ্ছে, জামিন হল একটি আইনি সুবিধা, যা আদালত কর্তৃক প্রদান করা হয়; তবে এটি একটি নিরঙ্কুশ অধিকার নয়, বিশেষত জামিন-অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬, ৪৯৭ এবং ৪২৬ ধারায় জামিনের বিধান উল্লেখ করা আছে। এই ধারাগুলি জামিন প্রদানের প্রক্রিয়া এবং শর্তাবলী নির্ধারণ করে। জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে, আদালত সাধারণত জামিন মঞ্জুর করেন। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যদি না কোনো বিশেষ কারণ থাকে। জামিন-অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে, জামিন একটি অধিকার নয়। এই ধরনের মামলায় জামিন একটি বিশেষ সুবিধা হিসেবে বিবেচিত হয়। জামিন-অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে, কেবলমাত্র উপযুক্ত এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে আদালত জামিন মঞ্জুর করতে পারেন। এটি আদালতের বিবেচনাধীন বিষয়। আদালত প্রতিটি মামলার স্বতন্ত্র পরিস্থিতি বিবেচনা করে জামিন মঞ্জুর বা নাকচ করার সিদ্ধান্ত নেন। জামিন মঞ্জুর করার সময় আদালত বিভিন্ন শর্ত আরোপ করতে পারেন, যেমন নিয়মিত আদালতে হাজিরা দেওয়া, পাসপোর্ট জমা দেওয়া, ইত্যাদি। জামিনের মূল উদ্দেশ্য হল আসামিকে বিচার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া, একই সাথে নিশ্চিত করা যে তিনি পালিয়ে যাবেন না বা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্নিত করবেন না। জামিন নাকচ হলে, আসামি উচ্চ আদালতে আবেদন করতে পারেন। একইভাবে, রাষ্ট্রপক্ষও জামিন মঞ্জুরের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে।

 

তবে, জামিনযোগ্য মামলায় জামিন পাওয়া এবং জামিনঅযোগ্য মামলা জামিন পাওয়ার পরও জামিন বাতিল হতে পারে। কখন আপনার জামিন বাতিল হতে পারে, সেক্ষেত্রে হাসিনা আখতার বনাম মোঃ রায়হান, ৬৬ ডিএলআর (২০১৪) ২৯৮ মামলায় রায় থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, ৫ ক্ষেত্রে জামিন বাতিল হতে পারে। নিম্নে ৫ টি ক্ষেত্র নিয়ে আমরা আলোচনা করবোঃ  

 

১. পুনরায় একই অপরাধ করাঃ এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেখানে আদালত জামিন বাতিল করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন আসামি চুরির অভিযোগে জামিনে থাকাকালীন পুনরায় চুরি করে, তাহলে আদালত তার জামিন বাতিল করে হাজতে পাঠাতে পারে। এটি প্রমাণ করে যে আসামি সংশোধন হয়নি এবং সমাজের জন্য হুমকি হতে পারে।

 

২. তদন্ত ব্যাহত করাঃ আসামি যদি তদন্ত প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে, তাহলে তা জামিন বাতিলের কারণ হতে পারে। যেমন, যদি একজন আসামি সাক্ষীদের ভয় দেখায় বা তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাজে বাধা দেয়, তাহলে আদালত তার জামিন বাতিল করতে পারে।

 

৩. সাক্ষ্যপ্রমাণ নষ্ট করাঃ এটি একটি গুরুতর অপরাধ যা ন্যায়বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন আসামি মামলার সাথে সম্পর্কিত দলিল-দস্তাবেজ ধ্বংস করে বা লুকিয়ে ফেলে, তাহলে আদালত তার জামিন বাতিল করতে পারে।

 

৪. বিদেশে পালিয়ে যাওয়া বা আত্মগোপন করাঃ এটি প্রমাণ করে যে আসামি বিচার প্রক্রিয়া এড়াতে চাইছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন আসামি জামিনে থাকাকালীন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় বা নিজের পরিচয় গোপন করে অন্য জায়গায় বসবাস শুরু করে, তাহলে আদালত তার জামিন বাতিল করতে পারে।

 

৫. সহিংসতা বা প্রতিহিংসার কাজ করাঃ এটি প্রমাণ করে যে আসামি সমাজের জন্য হুমকি। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন আসামি জামিনে থাকাকালীন মামলার সাক্ষীকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করে বা হুমকি দেয়, তাহলে আদালত তার জামিন বাতিল করে হাজতে পাঠাতে পারে। 

 

এই পাঁচটি ক্ষেত্রে জামিন বাতিলের বিধান আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি নিশ্চিত করে যে জামিনে থাকা আসামিরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করবে। সুতরাং, জামিনে এসে এই ৫ টি কাজ কখনোই করবেন না। ধন্যবাদ। 

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.