প্রতিবন্ধীদের প্রতি অপরাধ এবং এর শাস্তি

বিবিধ আইন

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ এর ধারা ৩ অনুসারে, প্রতিবন্ধিতার বিভিন্ন ধরনকে আলাদা করে দেখানো হয়েছে, যা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা থেকে শুরু করে বুদ্ধিগত, বিকাশগত ও ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা পর্যন্ত বিস্তৃত। নিম্নে প্রতিবন্ধিতার প্রতিটি ধরন উল্লেখ করা হলঃ 

১। অটিজম বা অটিজমস্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারস (Autism or Autism Spectrum Disorders)

২। শারীরিক প্রতিবন্ধিতা (Physical Disability)

৩। মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা (Mental Illness Leading to Disability)

৪। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা (Visual Disability)

৫। বাকপ্রতিবন্ধিতা (Speech Disability)

৬। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা (Intellectual Disability)

৭। শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা (Hearing Disability)

৮। শ্রবণ-দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা (Deaf-Blindness)

৯। সেরিব্রাল পালসি (Cerebral Palsy) 

১০। ডাউন সিনড্রোম (Down Syndrome)

১১। বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা (Multiple Disability)

১২। অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা (Other Disability)

 

উপরিউক্ত এই ১২ ধরনের প্রতিবন্ধীদের সাথে আইনত প্রায় ৬ ধরনের অপরাধ হতে পারে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ এর ধারা ৩৭ অনুসারে উক্ত অপরাধ এবং অপরাধের বিপরীতে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। নিম্নে ৩৭ ধারার বর্ণিত অপরাধসমূহকে উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করা হলঃ 

(১) যদি কেউ কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তির আইনগত অধিকার অর্জনে বাধা সৃষ্টি করে বা এর চেষ্টা করে, তবে সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড, বা ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। 

ব্যাখ্যাঃ আইনের অধিকার সকল মানুষের জন্য সমান হওয়া উচিত এবং এই অধিকার থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বঞ্চিত করা অন্যায়। কোনো প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে কোনো আইনি সেবা না দিলে বা আইনগত সুযোগ থেকে বঞ্চিত করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

উদাহরণঃ ধরুন, একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তার সম্পত্তি ফিরে পেতে আদালতে মামলা করতে যান, কিন্তু তার প্রতিবন্ধিতার কারণে আদালতের কোন কর্মকর্তা বা আইনজীবী তাকে মামলা করতে বাধা দেন। এক্ষেত্রে সেই ব্যক্তি অপরাধ করেছে এবং তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যেতে পারে।

(২) যদি কেউ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির বণ্টনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে তার ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত করে, তবে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড, বা ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

ব্যাখ্যাঃ উত্তরাধিকারী হিসেবে সকলের সমান অধিকার রয়েছে, তবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা আইনত অপরাধ। আইনগতভাবে প্রতিটি ব্যক্তি তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেতে বাধ্য।

উদাহরণঃ একজন ব্যক্তি তার বাবার মৃত্যুর পর জমি বণ্টনে প্রতিবন্ধী ভাইকে বঞ্চিত করে। এই ঘটনায় সেই ব্যক্তি অপরাধ করেছে এবং তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হতে পারে।

(৩) যদি কেউ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সম্পত্তি আত্মসাৎ করে, তবে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড, বা ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

ব্যাখ্যাঃ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল বা আত্মসাৎ করা একটি গুরুতর অপরাধ। সমাজে তাদের সম্পত্তি সংরক্ষণের অধিকার সুরক্ষিত করতে এই ধারা প্রণয়ন করা হয়েছে।

উদাহরণঃ কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জমি আত্মসাৎ করতে তার এক আত্মীয় জাল দলিল তৈরী করে জমি নিজের নামে লিখে নেয়। এ ধরনের প্রতারণার জন্য সেই আত্মীয়কে তিন বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হতে পারে।

(৪) যদি কেউ কোন প্রকাশনা বা গণমাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে নেতিবাচক বা ক্ষতিকর ধারণা ছড়ায়, তবে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড, বা ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

ব্যাখ্যাঃ গণমাধ্যম বা পাঠ্যপুস্তকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যঙ্গ বা নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব সৃষ্টি করে, যা সমাজে তাদের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে। এই ধরনের কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

উদাহরণঃ যদি কোন সংবাদপত্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কৌতুক বা ব্যঙ্গাত্মক রিপোর্ট প্রকাশ করে যা তাদের সম্মানহানি করে, তবে সেই সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে এবং শাস্তি স্বরূপ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে।

(৫) যদি কেউ মিথ্যা বা ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির হিসেবে নিবন্ধিত হয়, তবে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদণ্ড, বা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

ব্যাখ্যাঃ মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতিবন্ধী পরিচয় গ্রহণ করা আসলেই অসৎ কাজ। যারা প্রকৃতপক্ষে প্রতিবন্ধী নয়, তাদেরকে নিবন্ধনের মাধ্যমে সুবিধা গ্রহণ থেকে বিরত রাখতেই এই শাস্তির বিধান।

উদাহরণঃ কেউ যদি কোনো সুবিধা পাওয়ার আশায় মিথ্যা প্রতিবন্ধী সনদ তৈরি করে এবং নিবন্ধিত হয়, তবে তাকে এক বছরের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হতে পারে।

(৬) যদি কেউ জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পরিচয়পত্র তৈরি করে, তবে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড, বা ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

ব্যাখ্যাঃ পরিচয়পত্র তৈরির সময় জালিয়াতি করা গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এটা শুধু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে না, বরং সমাজের সার্বিক নৈতিকতাকেও বিপন্ন করে।

উদাহরণঃ যদি কেউ জাল কাগজপত্র দিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পরিচয়পত্র তৈরি করে কোন সুবিধা নেয়, তবে তাকে ৭ বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে।

প্রতিবন্ধীদের সাথে অপরাধ করা যেমন আইনি অন্যায়, তেমনি মানবিকতারও লঙ্ঘন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ক্ষুণ্ন করা বা তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করলে আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। একজন আইনজীবী হিসেবে, আমি জনগণকে আহ্বান জানাই—প্রতিবন্ধীদের সমান অধিকার ও সম্মান দিন এবং কোনো অপরাধের শিকার হলে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। আইন সবার জন্য সমান।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.