ব্ল্যাংক চেক নিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন না তো?

বিবিধ আইন

ঢাকার মিরপুরে, ছোট ব্যবসা চালান রাশেদ সাহেব। অনেক বছর ধরে তিনি তার বন্ধু করিমের সাথে নগদে বাকীতে ব্যবসা করছেন। সম্প্রতি তাদের ব্যবসায় একটি বড় লেনদেন হয়, যেখানে করিম রাশেদের কাছে পাঁচ লক্ষ টাকা ঋণ হিসেবে নেয়। করিম বারবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন টাকাটা শোধ করে দেবেন, কিন্তু মাসের পর মাস পেরিয়ে যাচ্ছিল, টাকার কোনো খবর ছিল না, বাংলাদেশে ছোট ব্যবসায়ীদের যেটা নিত্যদিনের মাথাব্যথা। এই এক কারনে মানুষ এখন আরও কাউকে টাকা ধার দিতে চায় না, টাকা ধার দিয়ে এবার তার পিছে পিছে ঘুরতে হয়। এজন্যই ধার দেওয়া বন্ধ হচ্ছে, ব্যাংকের ব্যবসা রমরমা হচ্ছে।

যাই হোক, এক সন্ধ্যায় কয়েকজন পরিচিত যারা দুইজনেরই মিউচুয়াল বন্ধুবান্ধব, তাদের নিয়ে রাশেদ করিমের কাছে টাকা চাইতে গেলে করিম তাকে একটি চেক দেন। চেকটি ছিল ব্ল্যাংক। আর বলেন, আমাকে ২ মাসের সময় দে ভাই, আমি একটা লোণ করেই তোর টাকাটা দিয়ে দিবো।

রাশেদ বন্ধুকে বিশ্বাস করে চেকটি নিয়ে চলে যান। কিন্তু, করিমের সাথে আর দেখা হয় না। ২ মাস পরে রাশেদ করিমকে ফোন করলে করিম ফোন ধরে না, মেসেজের উত্তর দেন না; বাসায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সে শহরে নেই। রাশেদ বুঝতে পারেন, তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তিনি আইনি পরামর্শের জন্য একজন আইনজীবীর কাছে যান এবং চেকটি দেখান। আইনজীবী চেকটি দেখে অবাক হয়ে বলেন, “এই চেক দিয়ে তো আপনি কোনো মামলা করতে পারবেন না।” রাশেদ হতাশ হয়ে জানতে চান, “কেন স্যার?” আইনজীবী সাহেব বললেন, ‘আপনার দেওয়া এই চেকটি আইনিভাবে কোনো মূল্য বহন করে না। এটি একটি সইবিহীন কাগজ মাত্র। তাই এটি ব্যবহার করে চেক ডিজঅনার মামলা করা সম্ভব নয়। এটি আপনাকে হয়তো হতাশ করেছে, কিন্তু এটাই আইনের বাস্তব চিত্র।’

প্রিয় পাঠক, আপনি হয়তো রাশেদের মতো পরিস্থিতিতে পড়েছেন বা আইন না জেনে থাকলে আপনিও এমন পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন। একজন বিশ্বাসী বন্ধু বা পরিচিত মানুষ আপনাকে টাকার বদলে একটি ব্ল্যাংক চেক দিয়েছেন, যা হয়তো রাশেদের মতোই সইবিহীন ছিল। অনেকে মনে করেন, শুধু টাকার অঙ্ক লেখা না থাকলেই সেটা ব্ল্যাংক চেক। কিন্তু আইনগতভাবে ব্ল্যাংক চেক বলতে এমন চেককেই বোঝায়, যেখানে শুধুমাত্র টাকার অঙ্ক লেখা থাকে না এবং চেকটি প্রদানকারী নিজে স্বাক্ষর করে থাকেন। কিন্তু, রাশেদ সাহেবের ক্ষেত্রে যে চেকটি দেওয়া হয়েছে, তাতে স্বাক্ষরই ছিল না। এটি ব্ল্যাংক চেক নয়, বরং এটি একটি সইবিহীন কাগজ মাত্র।

এখন প্রশ্ন হলো, এমন সইবিহীন চেক নিয়ে কি আপনি কোনো আইনগত পদক্ষেপ নিতে পারবেন? আমাদের প্রচলিত আইন, বিশেষ করে নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যাক্ট, ১৮৮১ (The Negotiable Instruments Act, 1881), চেক সংক্রান্ত সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে। এই আইনের ১৩৮ ধারা চেক ডিজঅনার মামলা পরিচালনার প্রধান ভিত্তি। কিন্তু এই ধারায় মামলা করার জন্য কিছু পূর্বশর্ত পূরণ করতে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, চেকটি অবশ্যই চেকদাতার দ্বারা যথাযথভাবে স্বাক্ষরিত হতে হবে।

আইনের দৃষ্টিতে, একটি চেক তখনই বৈধ হিসেবে গণ্য হয় যখন তাতে চেকদাতার সই থাকে। সইবিহীন চেককে ব্যাংক কখনোই পেমেন্টের জন্য গ্রহণ করে না। অর্থাৎ, যখন আপনি রাশেদের মতো এই চেকটি ব্যাংকে জমা দেবেন, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ চেক ডিজঅনার করবে না। বরং তারা বলবে, এটি একটি অসম্পূর্ণ এবং অকার্যকর দলিল। আর যেহেতু ব্যাংক ডিজঅনারই করবে না, তাই ১৩৮ ধারায় মামলা দায়ের করার কোনো সুযোগই থাকবে না। রাশেদের গল্পে, তার আইনজীবীও ঠিক এই কারণটিই ব্যাখ্যা করেছেন।

একজন আইনজীবী হিসেবে, আমিও এই ধরনের অসংখ্য কেস দেখেছি, পড়েছি এবং পরিচালনা করেছি। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাদের দেশে চেক সংক্রান্ত প্রতারণা একটি সাধারণ ঘটনা। অনেক সময় মানুষ বন্ধুত্বের বা বিশ্বাসী সম্পর্কের কারণে সঠিকভাবে যাচাই না করেই ব্ল্যাংক চেক গ্রহণ করে। কিন্তু, একটা ব্ল্যাংক চেক বলতে যে, চেকে টাকার অংক থাকবে না কিন্তু চেক দাতার স্বাক্ষর থাকবে, এটা অনেকেই বুঝে না। সম্পূর্ণ খালি একটি চেক নিয়ে লাফাতে লাফাতে চলে আসে, মনে করে ইচ্ছেমত টাকার অংক বসিয়ে মামলা করে দিবে। কিন্তু, চেক দাতার স্বাক্ষর ছাড়া যে, চেক ডিজঅনার করাতে পারবে না, এটা মাথাতেই থাকবে না। এজন্য আসলে না জানাটাই মূল সমস্যা। আশা করি, এখন থেকে এমন ভুল আর করবেন না। কিন্তু ইতিমধ্যে যদি ভুল করে থাকেন, তাহলে করনীয় কি? 

করনিয়ঃ যে চেকটি আপনাকে দেওয়া হয়েছে, সেটি দিয়ে আপনি নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যাক্টের ১৩৮ ধারায় কোনো মামলা করতে পারবেন না। কারণ, চেকদাতার স্বাক্ষর নেই। তবে, হতাশ হবেন না। আপনার কাছে দুটি বিকল্প আছে:

  • বিকল্প ১: আপনি যার কাছ থেকে এই চেকটি পেয়েছেন, তার সাথে আবারও যোগাযোগ করে একটি নতুন, সম্পূর্ণ চেক চেয়ে নিন। এটিই সবচেয়ে সহজ এবং দ্রুত সমাধান।
  • বিকল্প ২: যদি তিনি নতুন চেক দিতে অস্বীকার করেন, তবে আপনি এটিকে একটি প্রতারণার দলিল হিসেবে ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে, আপনার প্রাপ্য টাকা ফেরত না দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি আপনাকে এই অসম্পূর্ণ চেকটি দিয়েছেন। এর জন্য আপনার কাছে থাকা মেসেজ, কল রেকর্ড বা অন্য কোনো প্রমাণ (যদি থাকে) ব্যবহার করতে পারেন।

তাই, সবসময়ই চেষ্টা করবেন, চেক নেওয়ার সময় সাথে একটা স্ট্যাম্প করে রাখতে। তাহলে কেন টাকা পান, সেই বিষয়টি প্রমাণ করতে পারবেন, যদি চেক হারিয়ে ফেলেন তাতেও আপনার প্রমাণ বিদ্যমান থেকে যাচ্ছে।

এই ধরনের সমস্যা নিয়ে আরও কিছু প্রশ্ন করা হয়। চলুন, সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করিঃ 

  • ব্ল্যাংক চেক দিলেই কি মামলা করা যাবে? উত্তর: ব্ল্যাংক চেকের উপর টাকার অঙ্ক বসিয়ে মামলা করা সম্ভব, যদি চেকটি চেক প্রদানকারীর দ্বারা স্বাক্ষরিত হয়। চেক দাতার যদি স্বাক্ষর না থাকে তাহলে আপনি চেক ডিজঅনারও করাতে পারবেন না, সেই অনুযায়ী চেক ডিজঅনারের মামলাও করতে পারবেন না। 
  • চেক ডিজঅনার মামলা করতে কি কি লাগে? উত্তর: চেক ডিজঅনার মামলা করতে হলে চেকটি অবশ্যই ব্যাংক থেকে ডিজঅনার হতে হবে। এছাড়া, চেকদাতার অবশ্যই স্বাক্ষর লাগবে। আজকাল তো ব্যাংকে চেকের উল্টো পিঠেও চেক দাতার ২ টি স্বাক্ষর দিতে বলে। 
  • সই ছাড়া চেক দিয়ে কি অন্য কোনো মামলা করা যায়? উত্তর: হ্যাঁ, এই ধরনের চেককে প্রতারণার একটি প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা করা যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে প্রতারণার অভিযোগের সপক্ষে আরও উপযুক্ত প্রমাণ জোগাড় করতে হবে।
  • ব্ল্যাংক চেক পাওয়া গেলে আমার প্রথম করণীয় কী? উত্তর: যদি আপনি কোনো ব্ল্যাংক চেক পান, তবে অবিলম্বে চেকদাতার সাথে যোগাযোগ করে টাকার অঙ্ক এবং তারিখ বসিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিন। যদি এটি সম্ভব না হয়, তবে এমন ব্ল্যাংক চেক নিতে অস্বীকার জানাবেন। 
close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.