হিন্দু বিধবা বিবাহ: বিধবার সম্পত্তি সংক্রান্ত অধিকার

উত্তরাধিকার আইন

জ্যাকি ও রাহুলের সুখের সংসার ছিল। তাদের একটি ছেলে, শিমুল, যার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। কিন্তু হঠাৎ করেই একটি দুর্ঘটনায় রাহুলের মৃত্যু হয়। জ্যাকি এক মুহূর্তে বিধবা হয়ে গেলেন। তার জীবন যেন থমকে গেল। রাহুলের মৃত্যুর পর জ্যাকি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে শিমুলের লালন-পালনে নিয়োজিত করলেন। তিনি মনে করলেন, এখন থেকে তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হল শিমুলকে মানুষ করা। কিন্তু সমাজ তাকে শান্তিতে থাকতে দিল না। এমনিতেই কম বয়সে বিধবা হলে শ্বশুর শাশুড়ি থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশী নানা অপবাদ দিতে থাকে আর কিছু পুরুষ শুরু করে বিকৃত প্রস্তাব দেওয়া। সবকিছু হজম করে জ্যাকি কোনমতে শিমুলের দিকে তাকিয়ে থেকে সংসার করতে থাকলো। 

এভাবেই চলছিল কিছুদিন। রাহুলের মৃত্যুর প্রায় দুই বছর পর, রানবীর নামে একজন যুবক জ্যাকিকে বিয়ে করতে চাইলেন। রানবীর ছিলেন জ্যাকি পূর্বেকার পরিচিত বন্ধু এবং তিনি জ্যাকির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি মনে করলেন, জ্যাকি ও শিমুলের জীবনে একজন পুরুষের উপস্থিতি প্রয়োজন।

 

জ্যাকি প্রথমে এই প্রস্তাবে রাজি হননি। তিনি ভাবলেন, সমাজ কী বলবে? তার শাশুড়ি-শ্বশুর কীভাবে নেবেন? সবচেয়ে বড় কথা, শিমুল কী বলবে?

কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারলেন যে তার জীবনেও একজন সঙ্গীর প্রয়োজন আছে। শিমুলেরও একজন বাবার দরকার। তাছাড়া, একজন বিধবা হিসেবে একা থাকা কত কঠিন, তা ধীরে ধীরে তিনি নিজেই অনুভব করছিলেন।

 

জ্যাকি জানতেন যে ১৮৫৬ সালের বিধবা বিবাহ আইন অনুযায়ী হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ আইনসম্মত। কিন্তু তিনি এও জানতেন যে এই বিয়ের ফলে তার অনেক কিছু হারাতে হবে। জ্যাকি তার আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করলেন। আইনজীবী তাকে জানালেন যে, বিধবার পুনরায় বিবাহ হলে সে তার পূর্বের স্বামীর নিকট আইনের দৃষ্টিতে মৃত হিসেবে গণ্য হয়। সে কারণে পুনর্বিবাহের পর তার প্রাক্তন স্বামীর সম্পত্তির ওপর যাবতীয় অধিকার লোপ পায়।

এই তথ্য জ্যাকিকে চিন্তিত করে তুলল। রাহুলের সম্পত্তি ছিল তার ও শিমুলের নিরাপত্তা। কিন্তু আইনজীবী তাকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিলেন। তিনি জানালেন যে বিধবার পুনরায় বিবাহ হলে মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার লোপ পেলেও পূর্ব স্বামীর ঘরের ছেলের মা হিসেবে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। কারণ, বিধবার পুনরায় বিবাহ হলেও প্রাক্তন স্বামীর ঔরসজাত ছেলের সাথে মা-ছেলে সম্পর্ক থেকেই যায়।

 

এই তথ্যটি জ্যাকিকে কিছুটা স্বস্তি দিল। তিনি বুঝতে পারলেন যে তার পুনর্বিবাহ হলেও শিমুলের ভবিষ্যৎ নিরাপদ থাকবে। শিমুলের ভবিষ্যৎ নিরাপদ থাকলে জ্যাকি কোন মতে তার নিজের জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু এরপরও জ্যাকির মনে অনেক প্রশ্ন ছিল। তিনি ভাবলেন, সমাজ কীভাবে তার এই সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করবে? তার শাশুড়ি-শ্বশুর কী বলবেন? সবচেয়ে বড় কথা, শিমুল কীভাবে এই পরিবর্তন মেনে নেবে? 

জ্যাকি প্রথমে শিমুলের সাথে কথা বললেন। তিনি ধৈর্য ধরে শিমুলকে বোঝালেন যে, রানবীর তার নতুন বাবা হতে চান। শিমুল প্রথমে বুঝতে পারেনি, কিন্তু ধীরে ধীরে সে গ্রহণ করল। এরপর জ্যাকি তার শাশুড়ি-শ্বশুরের সাথে কথা বললেন। তারা প্রথমে রাজি হননি। তারা বললেন, “তুমি কি রাহুলকে ভুলে গেছ?” জ্যাকি তাদের বোঝালেন যে তিনি রাহুলকে কখনোই ভুলবেন না, কিন্তু তার ও শিমুলের জীবনে এগিয়ে যাওয়া দরকার।

 

অবশেষে, জ্যাকি রানবীরকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিয়ের দিন সমাজের অনেকেই কুৎসা রটালেন। কিন্তু জ্যাকি ও রানবীর সেগুলো উপেক্ষা করলেন। 

বিয়ের পর জ্যাকি অনুভব করলেন যে তার জীবনে একটা নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। রানবীর শিমুলকে নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করতে লাগলেন। শিমুলও ধীরে ধীরে রানবীরকে গ্রহণ করল।

কিন্তু, সমস্যা দেখা দিল যখন রাহুলের সম্পত্তির ব্যাপারে প্রশ্ন উঠল। রাহুলের পরিবার দাবি করল যে, জ্যাকির আর সেই সম্পত্তিতে কোনো অধিকার নেই। কিন্তু জ্যাকি জানতেন যে শিমুলের মা হিসেবে তার এখনও অধিকার আছে।

 

এখানে আমাদেরকে বিষয়টি বুঝতে সহযোগিতা করবে একটি মামলার রায়। ১৯০৫ সালের লক্ষণ বনাম শিবা মামলার রায় অনুযায়ী, বিধবার পুনর্বিবাহ হলেও তার প্রাক্তন স্বামীর ঔরসজাত সন্তানের সাথে মা-সন্তান সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ থাকে। সুতরাং, শিমুলের মা হিসেবে জ্যাকির রাহুলের সম্পত্তিতে অধিকার রয়েছে। সুতরাং, জ্যাকি যদিও পুনর্বিবাহ করেছেন, কিন্তু শিমুলের মা হিসেবে তার রাহুলের সম্পত্তি যা কিনা বর্তমানে শিমুলের সম্পত্তি, তা ইনডিরেক্টলি জ্যাকির অধিকার রয়েছে।

এই রায় শুধু জ্যাকির জন্য নয়, বাংলাদেশের অনেক হিন্দু বিধবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি প্রমাণ করল যে আইন বিধবাদের অধিকার রক্ষা করে। জ্যাকির গল্প প্রমাণ করে যে, হিন্দু বিধবা বিবাহ এখনও একটি জটিল ও সংবেদনশীল বিষয়। এটি শুধু আইনগত নয়, সামাজিক ও ধর্মীয় দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। জ্যাকির মতো অনেক নারী এখনও সমাজের কুসংস্কার ও বৈষম্যের শিকার হন। তবে, জ্যাকির সাহস ও দৃঢ়তা অন্য অনেক নারীকে অনুপ্রাণিত করেছে। তার গল্প প্রমাণ করে যে আইন ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনশীল। যা একসময় অকল্পনীয় ছিল, তা এখন বাস্তবতা। বর্তমানে, বাংলাদেশে হিন্দু বিধবা বিবাহ আইনগতভাবে স্বীকৃত। কিন্তু সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়া এখনও চ্যালেঞ্জিং। সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধি ও শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব।

 

শেষ পর্যন্ত, হিন্দু বিধবা বিবাহের বিষয়টি শুধু আইনি নয়, এটি সামাজিক ও মানবিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের সমাজের মূল্যবোধ, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সাম্যের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি সমাজ গড়া, যেখানে প্রত্যেকের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে, অথচ আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও সংরক্ষিত হবে। তাই, কুৎসা না রটিয়ে মানুষের কষ্ট বুঝতে শিখুন আর সেই অনুসারে সাপোর্ট করুন, সাপোর্ট করতে না পারেন অন্তত চুপ থাকুন। ধন্যবাদ। 

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.