সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার উপায়

বিবিধ আইন

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিদিনই অনেক মানুষের জীবনকে পাল্টে দেয়। এক মুহূর্তের অসাবধানতার কারণে কেউ হারাতে পারে প্রাণ, কেউ বা হারাতে পারে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। দুর্ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবারকে অর্থনৈতিক ও মানসিক সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। তবে বাংলাদেশের সড়ক পরিবহণ আইনের অধীনে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে, যা তাদের পুনর্বাসনে সাহায্য করতে পারে।

এই আর্টিকেলে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কিভাবে ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন, সেই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সড়ক পরিবহণ আইন ২০১৮ এবং সড়ক পরিবহণ বিধিমালা ২০২২ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের ধাপ, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তব উদাহরণ দিয়ে সহজ ভাষায় বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

ক্ষতিপূরণের পরিমাণঃ শুরুতেই জেনে নেই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হলে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কত হতে পারে। সড়ক পরিবহণ বিধিমালা ২০২২ এর ১৪৯ বিধিতে ক্ষতিপূরণের বিভিন্ন মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে, যার আলোকে ট্রাস্টি বোর্ড দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করে থাকে।

(ক) মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণঃ দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে বা আঘাতজনিত কারণে মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ এককালিন পাঁচ লক্ষ টাকা বা তার বেশি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ধরুন ইউসুফ নামের একজন ব্যক্তি তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন। একদিন রাস্তা পার হওয়ার সময় তিনি একটি দ্রুতগামী বাসের ধাক্কায় মারা যান। এই পরিস্থিতিতে, ইউসুফের পরিবার পাঁচ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে, ইউসুফকে তো তারা ফেরত পাবে না, অন্তত উক্ত ক্ষতিপূরণে তাদের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে সহায়ক হতে পারে।

(খ) গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গহানির ক্ষতিপূরণঃ যদি দুর্ঘটনায় কেউ তার শরীরের কোনো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হারান, যেমন হাত, পা বা চোখ, তাহলে তিন লক্ষ টাকা বা তার বেশি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আজম নামের একজন ব্যক্তি একটি দুর্ঘটনায় তার একটি পা হারিয়েছেন। এই অবস্থায়, তিনি এই ক্ষতিপূরণের আওতায় আসবেন এবং ট্রাস্টি বোর্ডের কাছ থেকে তিন লক্ষ টাকা পর্যন্ত সহায়তা পেতে পারেন।

(গ) গুরুতর আহত, তবে চিকিৎসা দিয়ে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা না থাকাঃ যদি কোনো ব্যক্তি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন এবং চিকিৎসা করেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে না পারেন, তবে তিনি তিন লক্ষ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য। উদাহরণস্বরূপ, সাদিক নামের একজন ট্রাক ড্রাইভার এক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন, যা তাকে শারীরিকভাবে অক্ষম করে দেয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তিনি আর কখনো স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারবেন না। এই পরিস্থিতিতে, সাদিকের পরিবার তিন লক্ষ টাকার আর্থিক সহায়তা দাবি করতে পারে।

(ঘ) গুরুতর আহত, তবে চিকিৎসা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনাঃ যদি কোনো ব্যক্তি গুরুতর আহত হন কিন্তু চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে, তবে তিনি এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। ধরুন, রিমা নামের একজন নারী একটি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন, তবে চিকিৎসকেরা জানান যে, সঠিক চিকিৎসা পেলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। এই ক্ষেত্রে, রিমা এক লক্ষ টাকার সহায়তা পাওয়ার যোগ্য।

ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পদ্ধতিঃ সড়ক পরিবহণ বিধিমালা ২০২২ এর ১৫০ বিধিতে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে। নিম্নে পয়েন্ট আকারে তুলে ধরা হয়েছে যাতে সহজেই বোধগম্য হয়। 

(১) আবেদন দাখিলঃ দুর্ঘটনার পর, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবারকে ফরম-৩২ অনুযায়ী দুর্ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আজিজ নামে একজন ব্যক্তি দুর্ঘটনায় আহত হন, তবে তার পরিবারের কেউ বা নিজেই এই ফরম পূরণ করে আবেদন করতে হবে।

(২) অনুসন্ধান ও প্রতিবেদনঃ আবেদন জমা দেওয়ার পর ১০ দিনের মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ড একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবে। এই কমিটি ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত করে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করবে এবং একটি প্রতিবেদন দাখিল করবে। ধরুন, রাশেদ নামে একজন ব্যক্তি দুর্ঘটনায় তার একটি পা হারিয়েছেন। তার পরিবারের কেউ আবেদন করার পর, ট্রাস্টি বোর্ড একটি অনুসন্ধান কমিটি পাঠাবে যা রাশেদের অবস্থার তদন্ত করবে এবং যথাযথ ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করবে।

(৩) ক্ষতিপূরণ প্রদানের সময়সীমাঃ অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন দাখিলের পর ট্রাস্টি বোর্ড ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ক্ষতিপূরণ মঞ্জুর করবে এবং আবেদনকারীকে চেকের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করবে। ধরুন, ফাহিম নামে একজন ব্যক্তি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন এবং তার পরিবারের কেউ ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন করেছেন। তাহলে বোর্ড ১০ দিনের মধ্যে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবে এবং ৩০ দিনের মধ্যে তাদের তদন্ত শেষ হবে। এরপর ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ফাহিম ক্ষতিপূরণের অর্থ পাবেন।

(৪) প্রয়োজনীয় কাগজপত্রঃ দুর্ঘটনার সাথে প্রাসঙ্গিক সকল তথ্য প্রমাণ নিজেদের সংগ্রহে রাখুন। যেমন, পুলিশ রিপোর্ট, মেডিকেল রিপোর্ট, ছবি (যদি থাকে), সাক্ষীদের বিবৃতিসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক দলিল। উদাহরণস্বরূপ, ফারহানা তার আবেদনের সাথে পুলিশ রিপোর্ট, হাসপাতালের ডিসচার্জ সার্টিফিকেট এবং দুর্ঘটনার স্থানের ছবি সংযুক্ত করলেন। এতে তার আবেদনটি শক্তিশালী হবে। 

সমস্ত চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র, প্রেসক্রিপশন, এক্স-রে, স্ক্যান রিপোর্ট ইত্যাদি সযত্নে রাখুন। এগুলো আপনার ক্ষতির প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে। যেমন, রাফি তার সকল মেডিকেল রেকর্ড সংরক্ষণ করেছিলেন। এর ফলে অনুসন্ধান কমিটি সহজেই তার আঘাতের গুরুত্ব বুঝতে পারল। 

দুর্ঘটনার সময় উপস্থিত ব্যক্তিদের নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বর সংগ্রহ করুন। তাদের বিবৃতি আপনার দাবিকে সমর্থন করবে। যেমন, নাজমুল দুর্ঘটনার সময় উপস্থিত দুজন ব্যক্তির যোগাযোগের তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। পরবর্তীতে তাদের সাক্ষ্য তার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করল।

সবশেষে, একজন আইনজীবী হিসেবে আমি পরামর্শ দিচ্ছি, যেকোনো দুর্ঘটনার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবেদন দাখিল করুন এবং সমস্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হালনাগাদ রাখুন। ক্ষতিপূরণের জন্য সঠিকভাবে আবেদন করা হলে তা দ্রুত অনুমোদিত হয় এবং প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা পাওয়া যায়, যা দুর্ঘটনার পরবর্তী জীবনের পুনর্গঠনে সহায়তা করতে পারে। একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না, তাই সড়কে নিরাপদে চলাচল করুন, ধন্যবাদ। 

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.