মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর সময়। কারণ, উত্তরাধিকার নির্ধারণের জন্য দেখা হয়, মৃত্যুর মুহূর্তে তার জীবিত উত্তরাধিকারী কারা ছিলেন। আমাদের সমাজে সাধারণত মৃত্যুর পরপরই সম্পত্তি বণ্টনের কথা বলা হয় না। কেউ বিষয়টি তুললে অনেক সময় তাকে সম্পত্তির প্রতি লোভী ভাবা হয়।
তবে, সম্পত্তি বণ্টনে দেরি করলে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। যেমন, যদি কোনো ওয়ারিশ পরবর্তীতে মারা যান, তাহলে তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যেও সম্পত্তি পুনরায় বণ্টন করতে হয়। এতে একাধিক ধাপে বণ্টনের প্রয়োজন পড়ে, যা আইনি ও পারিবারিক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
এ কারণে মুসলিম উত্তরাধিকার সূত্রের সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে, ব্যক্তি মারা যাওয়ার পরপরই তার সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করা উচিত। এতে ভবিষ্যতে অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা এড়ানো সম্ভব।
আজকে আমরা আলোচনা করব এমন যদি হয় যে, একই সাথে একাধিক ব্যক্তি মারা গেল যারা একে অন্যের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পেতে পারতো৷ এই ক্ষেত্রে সম্পত্তি বন্টনটা কিভাবে হবে?
সাধারণত আমরা জানি যে, একজন ব্যক্তি যখন মারা যায় তখন তার সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারদের মধ্যে বন্টন হবে। কিন্তু যদি এমন হয় যে, একই সাথে একাধিক ব্যক্তি মারা গেল যারা কিনা আগে পরে মারা গেলে একে অন্যের কাছ থেকে সম্পত্তি পেত কিন্তু তারা মারা গেল একদমই কাছাকাছি সময়। তখন উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বন্টনে বেশ জটিলতা দেখা দেয়। সামান্য আধা ঘন্টা, এক ঘন্টা আগে পরে মারা যাওয়ার কারণেও উত্তরাধিকারের সম্পত্তি বন্টনে ফারাক দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি কয়েক মিনিট আগে পরে মারা যাওয়ার ফলেও সম্পত্তি বন্টনে বেশ ফারাক দেখা দেয় এবং কয়েক মিনিটের আগে পরের জন্য কেউ সম্পত্তি পাচ্ছে, কেউবা বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছে৷ তো চলুন আজকে আমরা সেই বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করি।
একই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে সম্পত্তি বণ্টন কিভাবে হবে?
ধরা যাক, আলমগীর ও তার ছেলে মান্না একসঙ্গে গাড়িতে ভ্রমণ করছিলেন। সম্পর্কে তারা বাবা ছেলে, আলমগীর হচ্ছেন বাবা, মান্না হচ্ছেন তার ছেলে। আলমগীরের আরেক ছেলের নাম রুবেল। ঐদিকে মান্না বিবাহিত, তার স্ত্রীর নাম মৌসুমী এবং তার একমাত্র কন্যার নাম সাদিয়া।
একটি দুর্ঘটনায় আলমগীর এবং মান্না দুজনই মারা যান। এখন, প্রশ্ন হলো—কে আগে মারা গেছেন?
প্রথম পরিস্থিতি: বাবা আগে মারা গেলে
যদি আলমগীর (বাবা) দুর্ঘটনার সময় প্রথমে মারা যান এবং মান্না তখনও জীবিত থাকেন, তাহলে মান্না তার বাবার সম্পত্তির অংশ পাবেন। এরপর মান্না মারা গেলে, তার স্ত্রী মৌসুমী ও কন্যা সন্তান সাদিয়া সেই অংশের উত্তরাধিকারী হবেন। সেক্ষেত্রে, স্ত্রী আট ভাগের এক এবং কন্যা অর্ধেক সম্পত্তি পাওয়ার পর অবশিষ্ট সম্পত্তি আসাবা হিসেবে মান্নার ভাই রুবেলের কাছে চলে যাবে।
দ্বিতীয় পরিস্থিতি: ছেলে আগে মারা গেলে
কিন্তু যদি মান্না দুর্ঘটনায় স্পট ডেথ হন এবং পরে তার বাবা আলমগীর মারা যান, তাহলে সম্পত্তির বণ্টন সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। কারণ, আলমগীরের মৃত্যুর সময় মান্না জীবিত ছিলেন না। সুতরাং, ইসলামি আইন অনুযায়ী মান্না তার বাবার সম্পত্তি পাওয়ার কথা না।
এই পরিস্থিতিতে, আলমগীরের সম্পত্তি সরাসরি তার জীবিত সন্তান রুবেলের কাছে চলে যাবে। তবে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১-এর ৪ নম্বর ধারার ভিত্তিতে মান্নার কন্যা সাদিয়া তার বাবার পুরো অংশ পাবে। পূর্বের ন্যায় চাচা রুবেলের কাছে সম্পত্তি যাচ্ছে না৷ কিন্তু মান্নার স্ত্রী মৌসুমী কিছুই পাবেন না, কারণ ইসলামি আইনে বউমা শ্বশুরের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন না।
একই সাথে মৃত্যু অথচ কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানের কারণে সম্পত্তি বন্টনে কি ধরনের জটিলতা দেখা দিল, তা আশা করি বুঝতে পেরেছেন।
মৃত্যুর সময় নির্ধারণের আইনি জটিলতা
এই ধরনের পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কে আগে মারা গেছেন, তা নির্ধারণ করা। যখন একই দুর্ঘটনায় একাধিক ব্যক্তি মারা যান, তখন অনেক সময় চিকিৎসা সনদ, হাসপাতালের রিপোর্ট বা অন্যান্য প্রমাণের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনা, নৌ দুর্ঘটনা এবং অন্যান্য অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় একসঙ্গে পরিবারের একাধিক সদস্য মারা যাওয়ার হার বেড়েছে। ফলে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত জটিলতা এড়াতে মৃত্যুর সময় নির্ধারণ ও সম্পত্তি বণ্টনের প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর মুহূর্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানেও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী পরিবর্তিত হতে পারে। বিশেষ করে, একসঙ্গে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে কে আগে মারা গেছেন, সেটি নির্ধারণ করা আইনি ও পারিবারিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
তাই, পরিবারের মধ্যে ভবিষ্যৎ জটিলতা এড়াতে যথাসময়ে সম্পত্তি সংক্রান্ত কাগজপত্র হালনাগাদ করা, মৃত্যুর সময় নির্ধারণে সচেতন থাকা আবশ্যক।।
একটি মাত্র আর্টিকেলের মাধ্যমে এই বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। তবে, আমরা যথাসাধ্য স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছি। যদি আপনার কোনো মতামত থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় আমাদের জানান। আপনাদের প্রতিক্রিয়া আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে আরও বিস্তারিতভাবে এই বিষয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।
তাছাড়া, মুসলিম উত্তরাধিকার সংক্রান্ত জটিলতাগুলো সহজভাবে বোঝা ও প্রয়োগ করার জন্য ফারায়েজের জ্ঞান থাকা জরুরি। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে এবং আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকার বণ্টন সম্পর্কে আরও গভীর ধারণা পেতে, এডভোকেট চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিকের তত্ত্বাবধানে একটি অনলাইন কোর্স করতে পারেন। কোর্সে অংশগ্রহণ করতে ভিজিট করুন: academy.legalfist.com অথবা যুক্ত থাকুন আমাদের WhatsApp গ্রুপেঃ https://chat.whatsapp.com/J0k8ORSPgLO7l08crSm9dA

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )