মামলা স্থানান্তর প্রক্রিয়া

এক আদালত থেকে অন্য আদালতে মামলা স্থানান্তর প্রক্রিয়া

দেওয়ানি আইন বিবিধ আইন

কোন একটি দেওয়ানী মামলায় বাদী আপনাকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে আপনার নিকটস্থ আদালতে মামলা না করে যদি অন্য কোন আদালতে মামলা করে থাকে, সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই আপনার থেকে বিভিন্ন এলাকায় হওয়ায় আপনার যাওয়া-আসা সংক্রান্ত একটা অসুবিধা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি আপনার নিরাপত্তাও এক ধরনের ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। সে ক্ষেত্রে আপনি অবশ্যই চাইবেন বিবাদী হিসেবে আপনি আপনার মামলা স্থানান্তর করে আপনার এলাকায় নিয়ে আসতে। সেই ক্ষেত্রে কিভাবে আপনি একটি দেওয়ানী মামলাকে এক আদালত থেকে অন্য আদালতে স্থানান্তর করবেন সে বিষয়ে আজকে আমরা বিশদ আলোচনা করব। আমরা যে বিষয়গুলো আলোচনা করব তার পুরোটাই আমরা দেওয়ানী কার্যবিধি ১৯০৮ এর ২২ থেকে ২৪ ধারায় আলোচনা করা হয়েছে, আমরা কেবল এই ধারাগুলোকে সহজতর করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো। প্রথমে, আপনাকে মাথায় রাখতে হবে একটি মামলা কি নির্দিষ্ট একটি এলাকাতেই দায়ের করতে হবে নাকি একটি মামলা একাধিক আদালতে মামলা দায়ের করার মত। ধরুন, দেনমোহর আদায় করার জন্য আপনার স্ত্রী আপনার বিরুদ্ধে দেনমোহরের মামলা দায়ের করবেন, সে ক্ষেত্রে আপনি যে এলাকাতে বসবাস করেন সেই এলাকাতেও মামলা দায়ের করা যায় আবার আপনার স্ত্রী যে এলাকাতে বসবাস করেন সেই এলাকাতেও মামলা দায়ের করা যায়। এমন কি কেউ যদি চায় যে চাকরির সুবাদে অন্য নতুন কোন স্থানে বসবাস করলে সেই জায়গায় মামলা দায়ের করবে সেই ক্ষেত্রে সেটিও সম্ভব। কিন্তু কোনো স্থাবর সম্পত্তি অর্থাৎ জমিজমা নিয়ে যদি কোনো মামলা মোকদ্দমা হয়ে থাকে, সেই ক্ষেত্রে ওই জমিটি যে আদালতের অধীনে থাকে সে আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে কখনও কখনও একটি জমি একাধিক থানার অধীনে থাকতে পারে, সে ক্ষেত্রে উভয় থানার যে আদালত রয়েছে উভয় থানায় মামলা দায়ের করা যাবে। সে ক্ষেত্রে জমির পরিমাণ যে জায়গায় বেশি সে জায়গায় মামলা করা শ্রেয়। এখন ধরুন দেনমোহরের মামলা দিয়ে আমরা বোঝানোর চেষ্টা করি। যেহেতু জমির মামলা নির্ধারিত তারপরেও জমির মামলার ক্ষেত্রেও যদি জমি একাধিক থানার অধীন বা একাধিক জেলার অধীনে হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে মামলা এক থানা থেকে অন্য থানায় অথবা এক জেলা থেকে অন্য জেলায় স্থানান্তরের জন্য আবেদন করা যাবে। এখানে আপনার প্রশ্ন থাকতে পারে, আদালত তো জেলাতে একটাই থাকে, তাহলে থানা থেকে থানা স্থানান্তরের কথা কেন আসলো; জি আপনি ঠিক ধরেছেন। জেলাতে আদালত একটি কিন্তু জজ একজন নয়। প্রত্যেক থানার দেওয়ানী মামলার জন্য আলাদা আলাদা জজ রয়েছেন। এখন যেহেতু আদালত প্রাঙ্গণ একই, তাই থানা থেকে থানা পরিবর্তন তেমন সমস্যা নাই। আর জমির মামলা জেলা থেকে জেলা খুবই বিরল, কেননা একই জমি দুই জেলায় পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই, মামলা স্থানান্তরের জন্য পারিবারিক আদালতের মামলাগুলোকে উদাহরণ হিসেবে দেখানোই উত্তম।

 

আপনি থাকেন কর্মস্থল ঢাকাতে কিন্তু আপনার স্ত্রী থাকে সিলেটে। আপনার দেশের বাড়ি ধরুন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামকে বলা হয় প্রকৃতির মা আর সিলেটকে বলা হয় প্রকৃতির খালা। প্রকৃতির মা, খালা মিলিয়ে আপনার বাড়ি আর আপনার শ্বশুর বাড়ি। এখন যেকোনো কারণে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ঠিক চলছে না। আপনি আপনার স্ত্রীকে নিয়ে যদিও ঢাকা শহরে আগে থাকতাম কিন্তু আমাদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ার কারণে আপনার স্ত্রী বর্তমানে বাপের বাড়ি সিলেটে অবস্থান করছে। এখন আপনার স্ত্রী বাপের বাড়িতে থাকা অবস্থায় কারো প্রলোভনে পড়ে উল্টাপাল্টা বুদ্ধি শুনে আপনাকে তালাক নোটিশ পাঠিয়ে দিয়েছে; কিন্তু আপনি চাচ্ছেন যে আপনাদের সংসার টিকিয়ে রাখতে। সে ক্ষেত্রে আপনার স্ত্রী আপনার বিরুদ্ধে দেনমোহরের মামলা করেছে এবং আপনার সন্তানের ভরণপোষণের জন্য মামলা করেছে। আর এক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শ থাকবে অবশ্যই সোজাসুজি স্ত্রীর কাছে চলে যান, গিয়ে যা সমস্যা হয়েছে সমস্যার সমাধান করুন; সংসার টিকিয়ে রাখতে যা যা করা লাগে সে চেষ্টা করুন, প্রয়োজনীয় দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার জন্য মামলা দায়ের করতে পারেন। যাই হোক সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য যা করতে হয়, সেই চেষ্টা অবশ্যই করবেন।



এবার আসুন মামলার কার্যক্রমে। প্রথমেই দেনমোহরের মামলায় আপনাকে হাজিরা দিতে হলে ঢাকা থেকে সিলেট যেতে হচ্ছে যা, আপনার কর্মস্থলে খুব অসুবিধা হচ্ছে। কেননা আমরা জানি মামলার কার্যক্রম পরিচালিত হয়, রবি থেকে বৃহস্পতি বার আবার আপনার অফিসে হচ্ছে রবি থেকে বৃহস্পতি বার। একদিকে অফিস কামাই করা অন্যদিকে সিলেটে আসা-যাওয়া, আগে না হয় শ্বশুর বাড়ি ছিল এখন তো শ্বশুর বাড়ি গিয়ে উঠারও সুযোগ নেই; তার উপর আদালতের প্রাঙ্গণের বাইরেও শ্বশুরবাড়ির লোকদের ধমকি। সবকিছু মিলিয়ে আপনার কাছে সেটা বারংবার মোকাবেলা করার মতো মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলছেন। তখন আপনি চাইলে ওই মামলাটি আপনার বর্তমান ঠিকানা অর্থাৎ ঢাকাতে স্থানান্তর করে নিয়ে আসার জন্য আবেদন করতে পারেন। মামলা স্থানান্তরের পুরো প্রক্রিয়াটা যদিও আইনজীবীর মাধ্যমে আপনি করবেন, তারপরও আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আইনের খুঁটিনাটি প্রত্যেকটা জিনিস সাধারণ জনগণের জানা থাকুক। আপনার জেনে রাখার জন্য, জেলার বিভিন্ন থানার মামলা স্থানান্তর করতে হয় সে ক্ষেত্রে জেলা জজ কোর্টে আবেদন করতে হয়। কারণ হচ্ছে নিম্ন আদালত গুলোর আপিল আদালত হচ্ছে জেলা জজের আদালত। অন্যদিকে জেলার মামলা আরেক জেলায় স্থানান্তর করার সময় আপনাকে আবেদন করতে হবে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে। জেলার ভিতরে এক থানার মামলা অন্য থানায় স্থানান্তরের জন্য আপনাকে আবেদন করতে হবে জেলা জজের আদালতের। আর একজন জেলার মামলা অন্য জেলায় স্থানান্তরের জন্য আবেদন করতে হবে হাইকোর্ট ডিভিশনে। এর পিছনে থিউরি হচ্ছে, যে মামলাটি যে আদালতে চলমান রয়েছে এই মামলাটি রায় হওয়ার পরে যে আদালতে আপিল করতে হবে সেই আপিল আদালতেই আপনাকে উক্ত মামলাটি স্থানান্তরের জন্য আবেদন করতে হবে। জেলার ভিতরে আপীলের জন্য সর্বোচ্চ আদালত হচ্ছে জেলা জজ আর জেলা জজের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল শুনানি হয় হাইকোর্টে। জেলার ভিতরের মামলার স্থানান্তরের আবেদন তাই জেলা জজের আদালত আর এক জেলা থেকে অন্য জেলা হলে হাইকোর্টে।

হাইকোর্ট বিভাগ এবং জেলা জজ আদালত যেকোনো সময় চাইলে যেকোনো ধরনের মামলার কোন কার্যক্রম অধীনস্থ যেকোনো আদালতে স্থানান্তর করতে পারেন আবার চাইলে নিজের কাছে নিয়ে আসতে পারেন আবার এক আদালত থেকে অন্য আদালতে স্থানান্তর করতে পারেন।

যেহেতু মামলা-মোকদ্দমায় অবশ্যই বিপক্ষের সমান সুযোগ থাকা উচিত, নিজের আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ থাকা উচিত। আপনার যদি মনে হয় যে এই মামলাটি যে জায়গায় করা হয়েছে সেই জায়গায় থাকলে আপনি আপনার আত্মপক্ষ সমর্থন করার সঠিক সুযোগ পাবেন না, সেক্ষেত্রে আপনি চাইলে স্থানান্তরের জন্য আবেদন করতে পারবেন। উল্লেখ্য, এখানে পুরো প্রক্রিয়াটি দেওয়ানী আদালতের মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

আজকে এই পর্যন্তই, ধন্যবাদ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.