দেউলিয়া আইন

দেউলিয়া ঘোষণা কাদের করা যাবে এবং কাদের করা যাবে না?

দেওয়ানি আইন ব্যবসায়িক আইন

দেউলিয়া আইন নিয়ে আমরা একটা ধারাবাহিক পর্ব করার চিন্তা করছি। এই ধারাবাহিকে প্রবেশ করার পূর্বে আমাদেরকে দেখতে হবে, দেউলিয়া আদালত কাদেরকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারবে আর কাদেরকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারবে না। নিম্নে চার্টের মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করা হল আপনাকে দেউলিয়া আদালত দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারবে কিনা?

যাদেরকে দেউলিয়া ঘোষণা করা যাবে

১৯৯৭ সালের দেউলিয়া বিষয়ক আইনের ২(৩৬) ধারায় বলা হয়েছে যে, ব্যক্তি অর্থ- কোম্পানি, সংবিধিবদ্ধ বা অন্যবিধ সংস্থা, সমিতি ও অংশীদারি কারবার অন্তর্ভুক্ত হবে।যার ফলে নিম্নে যে তালিকা দেওয়া হবে সেখানে ব্যক্তি বললে কোম্পানি, সংবিধিবদ্ধ বা অন্যবিধ সংস্থা, সমিতি ও অংশীদারি কারবারকে বুঝাবে।

  • যদি কোন বিদেশী নাগরিক বাংলাদেশে অবস্থানকালে ঋণগ্রস্ত হয় এবং দেউলিয়াত্বমূলক কোন কর্ম করে তাহলে তাকে আইন অনুসারে দেউলিয়া ঘোষণা করা যাবে।অনুরূপভাবে কোন বিদেশী বাংলাদেশের কোন অধিবাসীর বিরুদ্ধে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আবেদন করতে পারবে। তবে দেউলিয়া বিষয়ক আইনের ১১(১) ধারা মোতাবেক, এইরূপ ক্ষেত্রে উক্ত বিদেশীকে কমপক্ষে ১ বৎসর বাংলাদেশে অবস্থান করতে হবে। 
  • ১৯৯৭ সালের দেউলিয়া বিষয়ক আইনের অধীনে জেলখানায় বন্দী থাকাকালীন অবস্থায় কোন কয়েদীকেও শর্ত সাপেক্ষে দেউলিয়া ঘোষণা করা যায়।
  • কোন বিবাহিতা মহিলা যদি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং এইরূপ ঋণের পরিমাণ যদি তার সম্পত্তির তুলনায় বেশী হয়ে যায় এবং তিনি যদি এইরূপ ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়েন, তাহলে দেউলিয়া আইন অনুযায়ী তাকেও দেউলিয়া ঘোষণা করা যাবে।
  • যৌথ হিন্দু পরিবারের সকল সদস্যগণ যদি একই সঙ্গে ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং দেউলিয়াত্বমূলক কর্ম সম্পাদন করে, তাহলে উক্ত যৌথ হিন্দু পরিবারের নাবালক কিংবা আইনত অযোগ্য সদস্য ব্যতীত সকল সদস্যকেই দেউলিয়া হিসাবে ঘোষণা করা যাবে।
  • [Chaturbhuj Vs. Kewal Ram (1925) AIR Mad. 1249] মামলার রায় অনুসারে, যেক্ষেত্রে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি একসঙ্গে ঋণ গ্রহণ করে এবং তারা উক্ত ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয় এবং সকলে একসাথে কিংবা আলাদা আলাদাভাবে কোন দেউলিয়াত্ব কর্ম সম্পাদন করে, সেইক্ষেত্রে একটি মাত্র আবেদনের প্রেক্ষিতেই সকল যৌথ দেনাদারকে দেউলিয়া হিসাবে ঘোষণা করা যাবে।
  • অংশীদারী কারবার এবং তার অংশীদার গণের আইনগত স্বত্বা একই। অর্থাৎ অংশীদারী কারবারের কোন পৃথক আইনগত স্বত্বা নাই। ফলে অংশীদারী কারবারের দায়-দেনার জন্য অংশীদারগণ ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকেন।অতএব, অংশীদারী কারবারের পৃথক কোন আইনগত স্বত্বা না থাকার কারণে, অংশীদারী কারবারের বিরুদ্ধে সরাসরি দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করা যায় না, তবে পাওনাদারগণ এক বা একাধিক অংশীদারের বিরুদ্ধে দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করতে পারবেন। এইক্ষেত্রে আদালত উপযুক্ত মনে করলে সকল অংশীদারকেই দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারবে। তবে, নাবালক অংশীদারকে দেউলিয়া ঘোষণা করা যাবে না।উপরোক্ত সিদ্ধান্ত এসেছে, [Shivagouda Ravji Patil Vs. Chandrakant (1965) AIR. S.C. 212] মামলার রায় থেকে।
  • ১৯৯৭ সালের দেউলিয়া বিষয়ক আইন প্রণয়নের পূর্বে কোন নিবন্ধিত কোম্পানীকে দেউলিয়া ঘোষণা করা যেত না।১৯৯৭ সালের দেউলিয়া বিষয়ক আইনে ২(৩৬) ধারায় বলা হয়েছে যে, “ব্যক্তি” অর্থ কোম্পানী, সংবিধিবদ্ধ বা অন্যবিধ সংস্থা, সমিতি ও অংশীদারী কারবার অন্তর্ভুক্ত হবে, সুতরাং কোম্পানীকে ব্যক্তি হিসাবে গণ্য করার কারণে কোম্পানীকেও দেউলিয়া হিসাবে ঘোষণা করা যাবে। দেউলিয়া আইনের ৯২ ধারায় বলা হয়েছে যে, এই আইনের অধীন অপরাধ সংগঠনকারী ব্যক্তি যদি কোম্পানী হয়, তাহলে উক্ত কোম্পানীর মালিক, পরিচালক, ব্যবস্থাপক, সচিব বা অন্য কোন কর্মকর্তা বা প্রতিনিধি কর্তৃক অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলে গণ্য হবে, যদি না তিনি প্রমাণ করতে পারেন যে, উক্ত অপরাধ তার অজ্ঞাতসারে সংগঠিত হয়েছে অথবা উক্ত অপরাধ সংগঠন রোধ করার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।
  • ১৯৯৭ সালের দেউলিয়া বিষয়ক আইনের ২(৩৬) ধারার বিধান মোতাবেক সমিতিও ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হয়। যার প্রেক্ষিতে দেউলিয়া বিষয়ক আইন প্রণীত হবার পর যে কোন প্রকার সমিতিকে দেউলিয়া হিসাবে ঘোষণা করা যাবে।

আবার, অত্র আইনের ৯২ ধারার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, (ক) “কোম্পানী” বলিতে কোন বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ও সমিতি বা সংগঠনকে বুঝাবে; (খ) বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে “পরিচালক” বলিতে উহার কোন অংশীদার বা পরিচালনা বোর্ডের সদস্যকে বুঝাবে। অতএব, উপরোক্তভাবে দেউলিয়া বিষয়ক আইন ১৯৯৭ এর বিধান মোতাবেক যাদেরকে দেউলিয়া ঘোষণা করা যায় তা আলোচনা করা হল।



যাদেরকে দেউলিয়া ঘোষণা করা যাবে না

আদালত কতিপয় ব্যক্তি বা সংস্থাকে কখনো দেউলিয়া ঘোষণা করবেন না। কেননা, ১৯৯৭ সালের দেউলিয়া বিষয়ক আইনের ১১ (২) ধারায় যাদের তালিকা দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আদালত দেউলিয়া ঘোষণার কোন আরজিই গ্রহণ করবেন না। তালিকায় যারা রয়েছেনঃ

  • জাতীয় সংসদ এবং বিচার বিভাগীয় সংস্থাসহ কোন সরকারী সংস্থা;
  • দাতব্য বা ধর্মীয় সংস্থা;
  • মুখ্য উদ্দেশ্য আর্থিক লাভ নয় এমন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা;
  • সরকার কর্তৃক বা সরকারের আর্থিক সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত কোন স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান।

এই গেল সংস্থা সমূহ যাদের বিরুদ্ধে আদালত দেউলিয়া ঘোষণার কোন আরজিই গ্রহণ করবেন না।এবার দেখা যাক, ব্যক্তি পর্যায়ে কারা এই সুযোগটি পাবেন।

  • নাবালকঃ নাবালক যেহেতু তার বয়সের কারনে যেকোন ধরনের চুক্তি করতে অক্ষম, সেহেতু নাবালক কোন ব্যবসা বা লেনদেনে সম্পৃক্ত হওয়াটাই অবৈধ। নাবালকের যেমন উচিত নয় সাবালকত্ব অর্জনের পূর্বে বা সাবালক হওয়ার আগে কোন প্রকার চুক্তিতে পক্ষ হওয়ার, ঠিক তেমনি বাকিদেরও উচিত নয় কোন নাবালকের সাথে কোন প্রকার চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার। চুক্তি আইন ১৮৭২ অনুযায়ী, নাবালক কোন বৈধ চুক্তি সম্পাদন করতে পারে না। মজার বিষয় হচ্ছে, অনেকেই মনে করেন যে, কোন চুক্তি যেটি একজন নাবালক ব্যক্তি নাবালক থাকাবস্থায় সম্পাদন করেছিল, সেটি যদি নাবালক থাকাবস্থায় কোন সমস্যার সৃষ্টি না করে তবে নাবালক ব্যক্তি যখন সাবালক হয়ে যাবে তখন আর কোন ঝামেলা থাকবে না। কিন্তু, বিশেষ ভাবে দ্রষ্টব্য এই যে, নাবালক থাকাকালীন সময়ে সম্পাদিত চুক্তি তার সাবালকত্ব অর্জনের পরও বৈধ চুক্তির মর্যাদা লাভ করে না।
  • নাবালক ব্যক্তির ন্যায় চুক্তি আইনের বিধান মোতাবেক উম্মাদ কিংবা বিকৃত মস্তিষ্ক সম্পন্ন যে কোন ব্যক্তিই চুক্তি সম্পাদনের অযোগ্য। ফলে দেউলিয়া হওয়ার মত দায় অর্জনের ক্ষমতা তার থাকে না।সুতরাং কোন উম্মাদ কিংবা বিকৃত মস্তিষ্ক সম্পন্ন ব্যক্তিকে দেউলিয়া হিসাবে ঘোষণা করা যায় না। তবে, যদি কোন ব্যক্তি সুস্থ থাকা অবস্থায় ঋণগ্রস্ত হয় এবং দেউলিয়াত্ব কর্ম করে, তবে উম্মাদ বা মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটার পরও তাহাকে দেউলিয়া হিসাবে ঘোষণা করা যাইবে।
  • আইন অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন আদালতেই মামলা মোকদ্দমা চলতে পারে না। তাই মৃত ব্যক্তিকে কখনই দেউলিয়া হিসাবে ঘোষণা করা যায় না। তবে, যদি কোন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেউলিয়া ঘোষণা সংক্রান্ত মামলা চলাকালীন সময়ে উক্ত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে এবং এইক্ষেত্রে যদি আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত মৃত ব্যক্তিটি দেউলিয়া ঘোষণার উপযোগী ছিল, তবে সেইক্ষেত্রে আদালত সরকারি রিসিভার নিয়োগ করবে এবং যার কাজ হবে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি হতে দায়-দেনা নিষ্পত্তি করা।

মোটামুটি এই কয়জনকেই দেউলিয়া আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষণা করা যায় না।  উল্লেখ্য, যাদেরকে দেউলিয়া ঘোষণা করা যাবে না তাদের লিস্ট সীমাবদ্ধ হলেও যাদেরকে দেউলিয়া ঘোষণা করা যাবে তাদেরকেও লিস্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে যাতে যাকে তাকে দেউলিয়া ঘোষণা করা না হয়। পরবর্তী পর্বগুলোতে দেউলিয়া কেন, কিভাবে ঘোষণা করা হয়, সেটি বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.