বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, বিশ্বব্যাপী তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের হার প্রতি ১,০০০ জনে প্রায় ২.৯। অর্থাৎ, প্রতি ১,০০০ বিবাহের মধ্যে প্রায় ৩ টি বিবাহের পরিণতি হচ্ছে, তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ। পরিসংখ্যান দেখে যত স্বস্তি বোধ হচ্ছে, বাস্তবিক প্রেক্ষাপট কিন্তু খুবই ভয়াবহ। কেননা, এই পরিসংখ্যানটি প্রত্যেক দেশের প্রকৃত তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের হারকে প্রতিফলিত নাও করতে পারে, কারণ তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ আইনি নাও হতে পারে। যেমন আমাদের দেশে হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা আইনত তালাক বা বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে না, শুধু সেপারেশনের আবেদন করে আলাদা থাকতে পারে। তাছাড়া আরও অনেকেই আছেন যারা বিবাহ বা বিবাহ বিচ্ছেদ কোন কিছুই রাষ্ট্রীয় আইন অনুসারে করে থাকে না, এখনো সবই ধর্মীয় আইন অনুযায়ী বিবাহ করছে বা বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছে; যা পরিসংখ্যানের অংশ হতে পারছে না বা হচ্ছে না। তাই, পরিসংখ্যান দেখে উদাসীন না হয়ে বরং এখনি তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ প্রতিরোধে সোচ্চার হওয়া উচিত।
তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ এমন একটি কঠিন এবং মানসিক অভিজ্ঞতা, যা জড়িতদের জীবনে অর্থাৎ স্বামী স্ত্রীর জীবনে উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রভাব ফেলে। তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে যে নেতিবাচক তা যে শুধু আমি আপনি জানি তা কিন্তু নয়, যারা এই তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তারাও কিন্তু এই বিশেষ ভাবে অবগত; কাবিন বাণিজ্য বা দেনমোহর বাণিজ্য যারা করে, তাদের হিসেব আলাদা।
আজকে আমরা একটু হাল্কাভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করবো কিভাবে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ প্রতিরোধ করা যায়, যদিও তা ইতিমধ্যে মহামারীর ন্যায় রূপ ধারণ করেছে। এটি বলা বাহুল্য যে, বিবাহবিচ্ছেদ সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করা সব সময় সম্ভব হয় না, তবুও এমন কিছু পদক্ষেপ রয়েছে যা অনুসরণ করে দম্পতিরা সম্পর্ক ছিন্নের কথা ভাবার আগে বরং একটি সফল এবং দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের সম্ভাবনা বাড়াতে পারে।
তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমাণ কমানোর জন্য যা যা করা যেতে পারে:
- সম্পর্কে যখনি কোন দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে বা ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে তখনি সততার সাথে খোলামেলা করা উচিত। ব্যবসা হোক বা ব্যক্তিগত সম্পর্ক, যোগাযোগ যে কোনো ধরনের সফল সম্পর্কের চাবিকাঠি। আপনার চিন্তাভাবনা, অনুভূতি এবং উদ্বেগ সম্পর্কে আপনার সঙ্গীর সাথে খোলামেলা এবং সৎ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এটি ভুল বোঝাবুঝি কমাতে এবং বিশ্বাস গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে।
- আপনার সঙ্গী আপনার সাথে যেমন ব্যবহার করুক আপনি আশা করেন, আপনি প্রথমে আপনার সঙ্গীর সাথে তেমন ব্যবহার করুন। তাছাড়া, সম্মান দিলেই সম্মান পাওয়া যায়, আর সম্মান দিলে কেউ কখন ছোট হয়ে যায় না। সুতরাং, হীনমন্যতায় না ভুগে আপনার সঙ্গীর সাথে সম্মানের সাথে আচরণ করুন এবং তার অনুভূতিকে বিবেচনা আনুন। জানি, এসব বলা যত সহজ, করা ততো সহজ নয়। প্রয়োজন যথেষ্ট ধৈর্য এবং আর অনেক কিছু নীরবে হজম করা। এসব পরিস্থিতিতে শুধু একটা কথাই আপনাকে ধৈর্য ধরতে এবং নীরবে সমালোচনা বা অপবাদ হজম করতে সাহায্য করবে তা হচ্ছে, আপনি এই সম্পর্কটি ছিন্ন করলে অর্থাৎ তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ করে পুনরায় যার সাথে সম্পর্ক করবেন বা বিবাহ করবেন, তার কি নিশ্চয়তা যে তিনি আরও ভালো হবেন?
- তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ আগে এক মুহূর্তের মধ্যে হলেও এখন মানুষ অনেক পরিণত হয়েছে। এখন অনেক চিন্তা ভাবনা করে, সময় নিয়ে, অনেকের সাথে আলোচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নেয়। বাহিরের দেশে অনেক বিশেষজ্ঞ বা থেরাপি থাকলেও আমাদের দেশে তেমন ব্যবস্থা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে, আমাদের সকলেরই অনেক পরিচিত বিশ্বস্ত বন্ধু বান্ধব বা আত্মীয় স্বজন আছেন যারা ভালো পরামর্শ দিয়ে থাকেন; তাদের সাথে শেয়ার করবেন। ফেসবুকে স্ট্যাটাস না দিয়ে আপনারাদের দুইজনের কোন বিশ্বস্ত বন্ধু বা আত্মীয়ের কাছে শেয়ার করুন, এটা কাজে দিবে। আর অবশ্যই, একে অন্যের দোষ ধরে ধরে সামনে অগ্রসর হলে সমাধান হবে না। ছাড় দিয়ে দিয়ে সামনে অগ্রসর হতে হবে; আপনিও স্বয়ংসম্পূর্ণ না, উনিও না। তাই, একে অন্যকে ছাড় দিয়ে ছোট্ট সুন্দর এই জীবনটা পার করে দিন শুধু ভালোবাসা দিয়ে।
- প্রেম করার সময় বা বিয়ের শুরুর দিকে রোমান্স যতটা তুঙ্গে থাকে, সময় যেতে যেতে রোমান্সে ভাটা পড়তে থাকে। তাই, এটা ভাটা মাঝে মাঝে জোয়ার আনতে হবে। প্রেমপত্র তো উঠে গেছে, তবুও পারলে লিখুন, নয়ত ম্যাসেজ করুন। কোথাও ঘুরতে যান শুধু দুইজন। আর স্বপ্ন দেখুন দুইজন মিলে কি কি করতে চান ভবিষ্যতে এবং একে একে স্বপ্ন গুলো পূরণ করার চেষ্টা করুন। এক সময় এই স্বপ্নগুলোই আপনাদেরকে আর আলাদা হতে দিবে না। আপস করতে ইচ্ছুক: যে কোনো সম্পর্কের মধ্যে মতানৈক্য ও দ্বন্দ্ব থাকবেই। আপস করতে ইচ্ছুক হওয়া এবং আপনার উভয়ের জন্য কাজ করে এমন একটি সমাধান খুঁজে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের পর্বে আমরা একটি সামান্য ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম, যার মাধ্যমে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমাণটি হ্রাস করা যেতে পারে। ভবিষ্যতে আমরা তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের পিছনের কারণগুলো নিয়ে যুক্তি খণ্ডন মূলক বিশদ আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ্। সবশেষে বলতে চাই, তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের হার দেশ, ধর্ম, লিঙ্গ, সংস্কৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন রকম হলেও আমাদের সকলকেই যার যার অবস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন বা ব্রোকেন পরিবারকে উৎসাহিত করা উচিত না। সবাই সবার আশেপাশের মানুষদেরকে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিষ্ঠান পরিবারকে টিকিয়ে রাখার জন্য ইতিবাচক অবদান রাখার চেষ্টা করি। ধন্যবাদ।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )