পড়ন্ত বিকেলে হারুন বসেছিল পুরনো ডিভানে হেলান দিয়ে। জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসা ধুলোমাখা আলোয় তার মুখের ক্লান্তি স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। এক সময় এই বাড়ি ছিল হাসির শব্দে ভরা, এখন শুধু ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ। হারুনের স্ত্রী রাবেয়া ছিল তার দুনিয়ার কেন্দ্র। বছর ছয়েক আগে হারুন যখন ধরেছিল রাবেয়ার হাত, তখন তাদের ছোট্ট স্বপ্ন ছিল, একটা ছোট্ট সংসার, দু’চারটে ছেলেমেয়ে, আর এক চিলতে সুখ। কিন্তু সময়ের স্রোত যে কতটা বিষাক্ত হতে পারে, তা হারুন বুঝেছিল অনেক দেরিতে।
প্রথমদিকে সব ঠিকই চলছিল। তারপর ছোট ছোট তিক্ততা জমতে শুরু করল, কখনও টাকার টানাপোড়েন, কখনও আত্মীয়স্বজনের নাক গলানো, কখনও রাবেয়ার নিজেরই বদলে যাওয়া মন। হারুন চেষ্টা করেছিল সবকিছু ঠিক রাখার, কিন্তু ভালোবাসার গাছ যেদিন শিকড়ে নর্মাল পানির পরিবর্তে উত্তপ্ত পানি পায়, সেদিন তার সবুজ পাতাও ঝরে যেতে শুরু করে, গাছও ধীরে ধীরে তার প্রাণশক্তি হারাতে বসে।
একদিন, হঠাৎ করেই রাবেয়া হারিয়ে গেল। হোয়াটসঅ্যাপে কেবল একটা ম্যাসেজ রেখে, “আমি আর থাকতে পারছি না। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার, আমি বাঁচতে চাই, তুমি ভালো থেকো।”
হারুন তখন ভেবেছিল, মাথা গরম করে স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি গেছে, দুই দিন পর রাগ পড়লে ঠিকই ফিরে আসবে। কিন্তু, রাবেয়া আর ফিরে এলো না। বরং মাসখানিকের মধ্যে হারুন শুনতে পেল, রাবেয়া এখন অন্য একজনের সাথে সংসার করছে, একজন ধনী, শহুরে লোকের সাথে, যার নাম রাজীব।
হারুন প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি। রাবেয়া এমনটা করবে সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। তার উপর পাড়া প্রতিবেশীর বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তায় হারুনের হ্রদয় ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেছে।
দুইজনের মধ্যকার প্রেম, খুনসুটি, গভীর রাতে দুইজন দুইজনকে জড়িয়ে ধরে সংসারের কত স্মৃতি, সব যেন বাতাসে উড়ে গেল। তার উপর আসতে থাকল মিথ্যা অভিযোগ, থানায় হয়রানি, সমাজের চোখ রাঙানি। রাবেয়া নিজের দোষ আড়াল করতে, হারুনের নামে মিথ্যা মামলা ঠুকল, হারুন হয়ে গেলো নারী নির্যাতনকারী, যৌতুক লোভী পাষণ্ড এক পুরুষত্বহীন এক পুরুষ। বহুমুখী শোকে হারুন দিশেহারা।
টাকার সংকট, আত্মীয়স্বজনের দূরত্ব, একাকীত্ব, সব মিলিয়ে সে জিন্দা লাশ হয়ে গেলো। কিছুদিন জেল খেটে হারুন আবার নতুন জীবন শুরু করার কথা ভাবছে। জেলে গিয়ে হারুনের একটা ভালো উপলব্ধি হয়েছে, জীবন কখনো কারো জন্য থেমে থাকে না। জীবনের নিয়মই হচ্ছে, এগিয়ে যাওয়া। কেউ সঙ্গ দিতে পারে আবার কেউ সঙ্গ নাও দিতে পারে; সহযাত্রীও পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু যাত্রা পথে থেমে থাকা চলবে না।
তাই হারুন এবার মুক্তি চায়। দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা ভাবছে, নতুন করে একটা জীবন শুরু করার। কিন্তু, এখানেও সমস্যা। তার পথের বাঁধা এখনো সেই পুরনো সম্পর্কের টানাপোড়েন। হারুন আর রাবেয়ার মধ্যে তো ডিভোর্স হয়নি, কাবিনের টাকা পরিশোধ হয়নি, আইন তো এখনো তাকে আটকে রেখেছে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হারুন গেলো উকিলবাবুর কাছে। নীচে হারুন আর উকিলবাবুর কথোপকথনের মাধ্যমে হারুনের মতো যারা এমন পরিস্থিতিতে আটকে আছেন, তারা কীভাবে মুক্তি পাবেন চলুন সেটা জেনে নেই।
হারুন: উকিলবাবু, আমার স্ত্রী আমাকে ডিভোর্স না দিয়ে আরেক ছেলেকে বিয়ে করে সংসার করছে। এখন সে বলছে, আমি যেন কাবিনের টাকা দিয়ে ডিভোর্স দেই। আমার টাকাপয়সার অবস্থা ভালো না। সে আমাকে মিথ্যা মামলায়ও ফাঁসিয়েছে। প্রায় এক বছর হলো, কোনো যোগাযোগও নেই। এখন বলুন, আমি কি দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবো? নাকি আগে কাবিনের টাকা দিয়ে ডিভোর্স দিতে হবে?
উকিলবাবু: হারুন ভাই, আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। আপনার স্ত্রী যেহেতু আপনাকে ডিভোর্স না দিয়ে অন্য ছেলেকে বিয়ে করেছে, এটা আইন অনুযায়ী বৈধ নয়। দণ্ডবিধির ১৮৬০ এর ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী, স্বামী বা স্ত্রী জীবিত থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বিয়ে করা অপরাধ। এই কারণে আপনি তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে পারেন।
হারুন: আমি এখন নতুন করে বিয়ে করতে পারবো না?
উকিলবাবু: না, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার সঙ্গে তার আইনি বিচ্ছেদ (ডিভোর্স) সম্পন্ন না হয়, ততক্ষণ আপনি দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবেন না। যদি করেন, তাহলে আপনিও অপরাধে জড়াবেন এবং আপনার বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
হারুন: ও বুঝলাম। তাহলে এখন কী করবো?
উকিলবাবু: আপনার করণীয় হলো —
১. প্রথমে তাকে যথাযথ নিয়মে তালাক দিতে হবে।
২. তালাকের সময় কাবিনের টাকা, অর্থাৎ মোহরানা/দেনমোহর, স্ত্রীর ন্যায্য পাওনা। সেটা পরিশোধ করতে হবে।
৩. আপনি যদি এখনই পুরো টাকা দিতে না পারেন, তাহলে তার সাথে আপোষে সমঝোতার চেষ্টা করুন। কিস্তিতে বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে মিটমাটের প্রস্তাব দিতে পারেন।
৪. আর যদি সে আপনাকে মিথ্যা মামলায় হয়রানি করে থাকে, তাহলে আপনি তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগ করতে পারবেন।
হারুন: সে অমানুষ, তাই আমাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করেছে। তারচেয়ে বড় কথা, আমার সাজানো সংসার শুধু একটু বিলাসীতার জন্য তছনছ করে দিয়েছে। আমি ওর বিরুদ্ধে মামলা করে ওর মতো অধম হতে চাই না। ওকে আমি আল্লাহ্র হাতে ছেড়ে দিলাম।
উকিলবাবু: এটা আপনার মহানুভবতা।
হারুন: এখন তাহলে সবচেয়ে ভালো হবে আগে ডিভোর্সের কাজটা মিটিয়ে নেওয়া, তারপর দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবা, তাই তো?
উকিলবাবু: ঠিক বলছেন। আইনি প্রক্রিয়া মেনে ডিভোর্স দিয়ে তারপর বিয়ে করলে ভবিষ্যতে আপনার জন্য কোনো ঝামেলা থাকবে না।
উপরের গল্পের নামগুলো ছদ্মনাম হলেও হারুনের গল্প কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমাদের সমাজে, অল্পবিস্তর ভিন্ন রূপে, এমন ভাঙনের ইতিহাস ছড়িয়ে আছে। সম্পর্ক যখন দায়িত্বের চেয়ে আকাঙ্ক্ষায় ভারী হয়ে পড়ে, তখন তা সহজেই ভেঙে যায়। হারুনের মতো অনেকেই ভেঙে পড়েন, অনেকে হয়তো প্রতিশোধের আগুনে নিজেকে পুড়িয়ে ফেলেন। অথচ সমাধান হলো ধৈর্য, যুক্তি এবং সঠিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এগোনো। জীবন কখনোই এক ভুলে থেমে যায় না। হার মানলেও, হেরে যাওয়া জীবন নয়—নতুন করে দাঁড়ানোর নামই তো জীবন। তাই হারুনের মতো যারা অবিচারের শিকার, তাদের উচিত শান্ত মাথায় আইনের সহায়তা নিয়ে নিজেদের মুক্তির পথ তৈরি করা। ক্ষোভ নয়, সাহস এবং সততার সঙ্গে। কারণ অবশেষে, সত্যই জয়ী হয়।

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )