পরকীয়া

পরকীয়া – কি, কেন, কিভাবে?

পারিবারিক আইন

কি?
ইংরেজি Adultery (অ্যাডাল্ট) বা Extra Marital Affair (এক্সট্রা ম্যারিটাল এফেয়ার) হল বিবাহিত কোন ব্যক্তি তিনি পুরুষ কিংবা নারী যদি নিজের স্ত্রী কিংবা স্বামী ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে যা কিনা ধর্ষণ নয়, তবে তাকে পরকীয়া বলা হয়। যদিও আমাদের দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর কোথাও পরকীয়া শব্দটি নেই, কিন্তু দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা অনুসারে কোন বিবাহিত স্ত্রীর সাথে স্বামী ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তি যদি স্বামীর অনুমতি ব্যতীত শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং সেটি যদি ধর্ষণ না হয়ে থাকে তবে সে ক্ষেত্রে সেটিকে ব্যভিচার বলে গণ্য করা হবে এবং ব্যভিচার একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যার জন্য ৫ (পাঁচ) বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া যেতে পারে।

 

কেন?
মানুষ কেন পরকীয়া বা ব্যভিচার করে তার সুনির্দিষ্ট একটি কারণ লেখা সম্ভব নয়। কেননা এর বিভিন্ন কারণ রয়েছে, শারীরিক, মানসিক এবং পরিবেশ ভেদে আরো বিভিন্ন কারণে মানুষ পরকীয়া বা ব্যভিচার করে থাকতে পারে। এটি অপরাধটি কোন নির্দিষ্ট দেশ বা সংস্কৃতিতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি প্রাচীনকাল থেকেই এখন অবধি প্রায় সকল দেশে, সকল সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। তাই, এর কারণ নিয়ে আমরা আলোচনা না করে বরং আমরা এখানে আজকে আলোচনা করবো কেন পরকীয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এর জন্য আইন কি কঠোরতা অবলম্বন করছে না কি ছাড় দিচ্ছে, সেই বিষয়েও আমরা আলোচনা করার চেষ্টা করব। ১৮৬০ সালে যখন দণ্ডবিধি প্রণয়ন করা হয় তখন আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশরা শাসন করেছিল আর তখন তারা বিবাহ নামক এই প্রাচীন সংস্কৃতিকে সম্মান প্রদর্শন পূর্বক দণ্ডবিধিতে এই অপরাধীকে শাস্তি যোগ্য অপরাধী হিসেবে গণ্য করেছেন। যদিও বর্তমানে আইনটির একটি ত্রুটি ধরা পড়েছে কিন্তু তখনকার প্রেক্ষাপটে আইনটি যথেষ্ট যুগোপযোগী ছিল। কি ত্রুটি ধরা পড়েছে সেটা আমরা নিম্নে আলোচনা করব।

 

কিভাবে?
‘সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ’- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই একটি লাইন দিয়ে অনেক কিছুই বুঝে গিয়েছেন। যদিও আজকে আমরা বিবাহ নামক সংস্কৃতিটিকে খুবই খাটো করে দেখার চেষ্টা করছি। বস্তুত বিবাহের মাধ্যমে নর-নারী পরস্পরের মধ্যে প্রেম ভালোবাসা প্রকাশ করার প্রাকৃতিক উপায় খুঁজে পায় এবং প্রাকৃতিক নিয়মেই বংশ বিস্তারের মাধ্যমে পৃথিবীতে মানব সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখে। আর এই মানব সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং নিজের মৃত্যুর পরও নিজের বায়োলজিক্যাল অস্তিত্বকে পৃথিবীতে টিকে রাখার জন্য বিয়ের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়ে থাকে। আধুনিক যুগে জন্মনিয়ন্ত্রণের অনেক ধরনের পদ্ধতি আবিষ্কারের পূর্বে নর-নারীর প্রেমের ফলে যে সন্তান জন্ম লাভ করত সেই সন্তানের পিতা কে তা নির্ধারণ করার যে জটিলতা ছিল, সেটি দূরীকরণের জন্য বিবাহকে সবচেয়ে সুন্দর, পবিত্র এবং নির্ভরযোগ্য পন্থা মনে করা হতো। একজন পুরুষ একাধিক নারীর সাথে বিবাহ বন্ধন বা শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করার ফলে প্রতিটি গর্ভে সন্তান জন্ম নিলেও সেই সন্তানের পিতা ঐ পুরুষ ব্যক্তিটি এবং মাতা হচ্ছে যে গর্ভ ধারণ করল সে, এটা যতটা সহজতর ছিল; পক্ষান্তরে একজন নারী যদি একাধিক পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে বা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তখন উক্ত নারীর গর্ভে জন্ম লাভ করা সন্তানটির পিতা কে, সেটি নির্ধারণ করা অসম্ভব ছিল। যদিও বর্তমানে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে সেটি বের করাও সম্ভব তথাপি এটি ধর্ম এবং সামাজিক উভয় দিক থেকেই ঘৃণিত কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়। মুসলিম আইন অনুসারে যেখানে একজন পুরুষ সামর্থ্য থাকলে এবং সমতা বজায় রাখতে পারলে একই সময় চারজন স্ত্রী রাখতে পারেন, সেটি পর্যন্ত এখন কালের বিবর্তনে এবং আইনের বেড়াজালে খুবই জটিল হয়ে উঠেছে। এখন একজন মুসলিম পুরুষ প্রথম স্ত্রী থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বিয়ে করতে হলে প্রথম স্ত্রীর লিখিত পারমিশন নিয়ে তারপর বিবাহ করতে পারে। সেই হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, এখন পৃথিবী ক্রমেই এক জন পুরুষ এবং একজন নারী একই সময়ে মাত্র একটি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে পারবেন, এই থিউরিতে প্রবেশ করছে; সেটিও মন্দ নয়। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকা মানেই হচ্ছে, শুধুমাত্র বিবাহিত সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবেন, অন্য কারো সাথে নয়। একজন ব্যক্তির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকা অবস্থায় অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে স্বেচ্ছায় বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে সে ক্ষেত্রে সেটি পরকীয়া বা ব্যভিচার বলে গণ্য হবে। যদি স্বেচ্ছায় না করে থাকে তবে তখন সেটি ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।

আমাদের ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইনে একজন বিবাহিত স্ত্রীর সাথে যদি স্বামী ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তি শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে সেই ক্ষেত্রে সেটি পরকীয়া বা ব্যভিচার বলে গণ্য হবে। কিন্তু যদি একজন বিবাহিত পুরুষ অন্য কোনো নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে সেই ক্ষেত্রে সেটিকে ব্যভিচার বা পরকীয়া বলা যাচ্ছে না যতক্ষণ পর্যন্ত ওই তৃতীয় মহিলাটিও বিবাহিত হয়। অর্থাৎ, বিবাহিত পুরুষ ব্যক্তি যদি অবিবাহিত কোন নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে সেটি পরকীয়া বা ব্যভিচার বলে গণ্য হবে না। কেননা, আইনে শুধুমাত্র বিবাহিত স্ত্রীর সাথে বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ককে পরকীয়া বা ব্যভিচার বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

 

৪৯৭ ধারার আরও একটি দুর্বলতা হচ্ছে, পরকীয়া বা ব্যভিচারের জন্য শুধুমাত্র পুরুষ অপরাধীকেই আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে, অর্থাৎ শাস্তি প্রদান করা যাবে। যেখানে কিনা সকল অপরাধের জন্য আইনে সহযোগিতাকারী হিসেবে সহযোগীকে শাস্তি প্রদান করা যায়, সেখানে এই ধারায় সরাসরি উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে যে, অপরাধের সহযোগী হিসেবে স্ত্রী লোককে আইনের আওতায় আনা যাবে না, অর্থাৎ শাস্তি প্রদান করা যাবে না। ১৮৬০ সালের প্রেক্ষাপটে ঠিকই ছিল, কেননা তখনকার নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা ছিল না, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী ছিল অবলা, অবহেলিত। স্বামী বিদ্যমান থাকা অবস্থায় পর পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করা তখনকার নারীদের জন্য অকল্পনীয় ছিল। তাই কোনো পুরুষ যদি দুঃসাহস দেখিয়ে কোন বিবাহিত নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে তখন তাকে আইনের আওতায় আনা হতো, আর নারীকে ছাড় দেওয়া হতো সংসার টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। কিন্তু, বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন, এখন নারী-পুরুষের মধ্যে সর্ব স্তরের বৈষম্য তলানিতে এসে ঠেকেছে। নারী পুরুষ এখন শুধু আইনের দৃষ্টিতে সমান তা নয়, বরং প্রত্যেকটি স্তরেই নারী-পুরুষের সমতা দৃশ্যমান। তাই এই আইনের উক্ত বিধানটি সংশোধন করে নারী হোক কিংবা পুরুষ, বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকা অবস্থায় বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপন করলেই তাকে পরকীয়া বা ব্যভিচারের অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করে শাস্তি প্রদান করা হোক। পাশাপাশি যে দুইজন পরকীয়া বা ব্যভিচারে লিপ্ত দুইজনকেই উক্ত অপরাধে পরস্পরের সহযোগী হিসেবে একই চার্জে বিচার করা হোক।

আর যাতে কোন নির্দোষ স্বামী বা স্ত্রী বা কোন মাসুম সন্তানকে পরকীয়া বা ব্যভিচারের বলি হতে না হয়, মানব সভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানটি যে থাকে পবিত্র এবং অক্ষুণ্ণ, সেজন্য যথা শীঘ্রই আইন সংশোধন করে এর প্রয়োগে কঠোরতা প্রদর্শন করা উচিত। দিন শেষে সবাই যেন হাসি মুখে ফিরতে পারে নিজ নিজ পরিবারের কাছে, এই আশা ব্যক্ত করে আজকে এই পর্যন্তই। ভবিষ্যতে বাস্তব কেস স্টাডিসহ পরকীয়া বা ব্যভিচারের নেতিবাচক দিক গুলো নিয়ে লেখার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ্‌। ধন্যবাদ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.