বিবাহ আইন

মুসলিম আইনে বিয়ের যত নিয়ম-কানুন

পারিবারিক আইন

বিয়ে হচ্ছে এক ধরনের দেওয়ানী চুক্তি। আর চুক্তি সম্পাদনের জন্য চুক্তিতে অন্তত দুইটি পক্ষ থাকতে হবে। পক্ষদ্বয়কে প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক কেউই চুক্তির পক্ষভুক্ত হতে পারবে না। এর কারণ হচ্ছে, চুক্তি ফলে সৃষ্ট সুবিধা অসুবিধা বুঝার মত বোধশক্তি অপ্রাপ্ত বয়স্কদের থাকার কথা নয়। তাই, বিয়েতেও বিয়ের পক্ষদ্বয়কে প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে। মুসলিম আইন অনুসারে বিয়ের জন্য স্পষ্টত কোন বয়স নির্ধারণ করা না থাকলেও রাষ্ট্রীয় আইন তথা বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুসারে, বিয়ের জন্য বরের বয়স হতে হবে অন্তত ২১ এবং কনের বয়স হতে হবে ১৮; যা এখন বাংলাদেশে অবস্থিত যেকোনো ধর্ম অনুসারে বিয়ে করতে গেলেই মানতে বাধ্য। অতএব, মুসলিম আইন অনুসারে বিয়ের প্রথম শর্তটি সম্বন্ধে আমরা জানলাম।

এবার আসুন, পাত্র পাত্রী দুইজনই প্রাপ্ত বয়স্ক অর্থাৎ বর ২১ এবং কনে ১৮, এমতাবস্থায় যেটি প্রয়োজন সেটি হচ্ছে, যেকোনো এক পক্ষ হতে প্রস্তাব এবং অপর পক্ষ থেকে সম্মতি। এমন নয় যে, প্রাপ্ত বয়স্ক হলেই যে কেউ যে কাউকে বিয়ে করতে পারবে। উভয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া যেমন জরুরী, তেমনি উভয়ে নিজেদের মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন করতে আগ্রহী কিনা সেটাও জরুরী। তাই, এক পক্ষ প্রস্তাব দিতে হবে এবং প্রতি উত্তরে অপর পক্ষ সম্মতি জানাতে হবে।

উভয় পক্ষের যখন বিয়েতে সম্মতি থাকবে তখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্বিমত সৃষ্টি হবে বিয়ের দেনমোহর নিয়ে। দেনমোহর হচ্ছে স্ত্রীর হক। স্ত্রীকে দেনমোহর প্রদান করা স্বামীর উপর ফরজ। আল্লাহ তা’আলা সূরা নিসার ৪ নাম্বার আয়াতে বলেন, “আর তোমাদের স্ত্রীদের তাদের দেনমোহর দিয়ে দাও খুশী মনে। অবশ্য স্ত্রী চাইলে দেনমোহর কিছু অংশ কিংবা অংশ ছেড়ে দিতে পারে।” স্ত্রী যদি মাফ করে দেয় বা দেনমোহর খুশী মনে ছেড়ে দেয়, তাহলে তো কোন সমস্যা নাই, কিন্তু এর জন্য স্ত্রীকে কোন ভাবে চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। আমাদের দেশে যেহেতু বিয়ের সময় পুরো দেনমোহর পরিশোধ করা লাগে না, কিছু অংশ উশুল হিসেবে দিয়ে বাকিটা বকেয়া রাখা যায়, সেহেতু কেউ যদি আবার মনে করে যে, বাকী অংশ সে পরিশোধ করবে না, তাহলে এই হাদিসটি তার জন্য,
রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তির কোন মেয়েকে দেনমোহর দেওয়ার ওয়াদায় বিয়ে করেছে কিন্তু দেনমোহর দেওয়ার ইচ্ছে নেই, সে কেয়ামতের দিন আল্লাহ্‌র নিকট ব্যভিচারী হিসেবে দাঁড়াতে বাধ্য হবে– (মুসনাদে আহমাদ)

অতএব, দেনমোহর নিয়ে কোন প্রকারের চালাকি চলবে না। আপনার সাধ্য মত আপনি দেনমোহর নির্ধারণ করবেন, যদিও আমাদের সমাজে এটা নিয়ে বেশ চাপাচাপি হয়। মেয়ে পক্ষ একটু বেশি দেনমোহর দাবি করে থাকে, তবুও আপনার উচিত আপনি যেটা পরিশোধ করতে সক্ষম, ঠিক সেই পরিমাণ দেনমোহর নির্ধারণ করা এবং যথাসম্ভব বিবাহ লগ্নেই পরিশোধ করে দেওয়ার। (দেনমোহরের আদ্যোপান্ত অনুচ্ছেদে দেনমোহর নিয়ে খুঁটিনাটি লেখা আছে, সেটি পড়ে দেখতে পারেন।)

দেনমোহর যখন নির্ধারণ হয়ে গেল এবার আসবে বিয়ের সাক্ষী। মুসলিম বিয়েতে দুই জন পুরুষ বা একজন পুরুষের সাথে দুই জন নারী সাক্ষী থাকলেই বিয়ে সম্পন্ন করা সম্ভব।


সব যখন প্রস্তুত তখন বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য একজন কাজীকে ডেকে এনে ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসারে বিয়ে সম্পন্ন করে যাবে। ধর্মীয় আইন অনুসারে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলেও রাষ্ট্রীয় আইন অনুসারে উক্ত বিয়েকে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধিকরণ) আইন ১৯৭৪ অনুযায়ী বিবাহ রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক। বিবাহ সম্পন্নের ৩০ দিনের মধ্যে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করার পরও যদি কেউ এই আইন অমান্য করে তবে সেই ক্ষেত্রে দুই বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ৩০০০/- টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ড দিতে পারে। তবে উল্লেখ্য, এক্ষেত্রে শাস্তি শুধুমাত্র উক্ত বিয়ের স্বামীকে প্রদান করা হবে।

তাছাড়া, বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করার প্রয়োজনীয়তা এবং উপকারিতা কিন্তু অনেক। বিশেষ করে, স্ত্রীদের জন্য তো এটি একটি রক্ষাকবচ। কেননা, কাবিননামা না থাকলে শুধু হুজুর ডেকে বিয়ে পড়ানো হলে সেই বিয়ে বিয়ে যেকোনো সময় স্বামী অস্বীকার করলে কিছুই করার নেই। স্বামী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করলে দেনমোহরের টাকার জন্যও কোন আইনি পদক্ষেপ নিতে পারবে না। তাছাড়া, স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর সম্পত্তিতে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। স্বামীর সাথে বিদেশে যেতে হলেও আজকাল পাসপোর্টে স্ত্রীকে কাবিননামার ভিত্তিতে সত্যায়িত করতে হয়। তাছাড়া, সামাজিক স্বীকৃতির জন্যও আমাদেরকে এখন কাবিননামা সংরক্ষণ করতে হয়। তাছাড়া, অনেক সময় অনেক জায়গায় অনেক পরিস্থিতিতে স্বামী স্ত্রী হিসেবে নিজেদেরকে প্রমাণ করতে হলেও কাবিননামার বিকল্প নেই। তাছাড়া, আপনার স্বামী বা স্ত্রী আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে থাকাবস্থায় যেন অন্যত্র দ্বিতীয় বিয়ে করতে না পারে তার জন্যও আপনাদের বিয়ের কাবিননামা থাকা উচিত এবং সেটি রেজিস্ট্রিকৃত।

আসুন এবার জেনে নেই, বিবাহ রেজিস্ট্রেশনে খরচ কতো? দেনমোহর ৪ লক্ষ টাকা পর্যন্ত প্রতি হাজারের জন্য রেজিস্ট্রেশন ফী ১২.৫০ টাকা। ৪ লক্ষের উপরে গেলে পরবর্তী প্রতি ১ লাখে ১০০ টাকা করে। তবে, দেনমোহর যাই হোক না কেন, রেজিস্ট্রেশন ফী ২০০ টাকার কম কখনো হবে না। এই রেজিস্ট্রেশন ফী বরকে পরিশোধ করতে হবে।

কাবিন রেজিস্ট্রেশন কথা উঠলে অনেকেই তালাক রেজিস্ট্রেশনের ফী সম্বন্ধে জানতে চায়। আসুন সংক্ষেপে জেনে নেই, তালাক রেজিস্ট্রেশনের ফী কত?

তালাক রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধনের জন্য ৫০০ টাকা ফী গ্রহণ করতে পারবেন রেজিস্টার। তাছাড়া, নকলের জন্য ৫০ টাকা, তল্লাশির জন্য ১০ টাকা এবং যাতায়াতের অপশন যদি থাকে তবে সেক্ষেত্রে প্রতি ১ কিলোমিটারের জন্য ১০ টাকা করে ফী নিতে পারবেন। আমার এই লেখা পড়ে আপনি যদিও ঠোঁট উলটচ্ছেন, জানি বাস্তবে এরচেয়ে অনেক বেশি টাকা নিয়ে থাকে, তবুও কিছু করার নেই, লিখতে হয়। আজ জানা থাকলে ধীরে ধীরে সেটা মানা হবে, এখন আমাদের দায়িত্ব আগে আইনটা সর্বস্তরে সবচেয়ে সহজ ভাষায় বিনামূল্যে পৌঁছে দেওয়া। একদিন আইন জানা লোকদের সংখ্যা যখন বেড়ে যাবে তখন আইন মানাটাও বেড়ে যাবে আর তখনি আমরা আইনের শাসন তথা আইন মানা একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.