স্ত্রীর জীবদ্দশায় স্বামীর মৃত্যু হলে আমরা ঐ স্ত্রীলোককে বিধবা বলে থাকি; অন্যদিকে স্বামীর জীবদ্দশায় স্ত্রী মৃত্যুবরণ করলে ঐ স্বামীকে আমরা বিপত্নীক হিসেবে অভিহিত করি। আজকে আমরা আলোচনা করবো, বিধবা নারী তার স্বামীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার সূত্রে অধিকার রয়েছে তা নিয়ে।
আমাদের সমাজে, স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুর বাড়িতে বিধবা নারীর মূল্য কমে যেতে থাকে। নানাভাবে তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার জন্য শ্বশুরবাড়ির লোকেরা চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। স্বামীর মৃত্যুর সময় যদি সন্তানরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে হয়তো এই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হতে হয় না। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর সময় যদি সন্তানরা খুবই ছোট অর্থাৎ নাবালক থাকে বা কোন সন্তান না থেকে থাকে, সে ক্ষেত্রে বিধবা নারীকে তার স্বামীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার সূত্রে অধিকার বা হকটুকু আদায় করতে যথেষ্ট নাজেহাল হতে হয়। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে অনেক পরিবারে দেখা যাবে যে, স্বামীর অকাল মৃত্যুতে বিধবা নারীর পুনরায় বিয়ে করার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও শ্বশুরবাড়িতে পড়ে থাকে শুধুমাত্র সম্পত্তি পাওয়ার আশায়। কেননা বিধবা নারী পুনরায় বিবাহ করলে আমাদের দেশের তথাকথিত সালিশদাররা তার প্রথম স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে দেয়। কিন্তু মুসলিম আইন অনুসারে কোন ব্যক্তি মারা যাওয়ার সময় তার সাথে যে মহিলার বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল অর্থাৎ সে ব্যক্তি মারা গেল, মারা যাওয়ার সময় পর্যন্ত যে স্ত্রীর সাথে তার বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল, সেই স্ত্রী তার মৃত স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাবে। কিন্তু যদি স্ত্রীকে তালাক দিয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাবে না।
এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, স্ত্রী লোকটি তার মৃত স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে কতটুকু সম্পত্তি পাবেন। এখানে হিসাবটি একদম সিম্পল; সন্তান যদি থেকে থাকে তাহলে মৃত স্বামীর সম্পত্তি থেকে ১/৮ (আট ভাগের এক ভাগ) অংশ পাবেন, কিন্তু সন্তান যদি না থেকে থাকে তাহলে ১/৪ (চার ভাগের এক) অংশ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সন্তান কার সন্তান?
এই সন্তান হচ্ছে মৃত ব্যক্তির সন্তান। এখন মৃত ব্যক্তির সাথে এই বিধবা নারীর সন্তান হতে পারে আবার মৃত ব্যক্তির পূর্বের বা অন্য কোনো সংসারের সন্তানও হতে পারে। এক কথায়, মৃত ব্যক্তির যদি সন্তান থেকে থাকে তাহলে স্ত্রীলোকটি ১/৮ বা আট ভাগের এক ভাগ পাবে আর মৃত ব্যক্তি যদি নিঃসন্তান হয়ে থাকে সেই ক্ষেত্রে তিনি ১/৪ বা চার ভাগের এক ভাগ পাবেন। এখানে মজার বিষয় হচ্ছে, বিধবা নারীর যদি পূর্বের অন্য কোথাও বৈবাহিক সম্পর্ক থাকা অবস্থায় সন্তান থাকে, এই কারণে তিনি চার ভাগের এক ভাগ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে না। কারণ আমরা যে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে কথা বলছি ওই ব্যক্তি নিঃসন্তান হলেই উনার স্ত্রী হিসেবে ঐ বিধবা নারী চার ভাগের এক ভাগ সম্পত্তি পাওয়ার জন্য অধিকারী। এখন কথা হচ্ছে মৃত ব্যক্তির যদি একাধিক স্ত্রী থেকে থাকে সে ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টন কিভাবে হবে এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের মধ্যে সব সময় তালগোল পাকিয়ে ফেলি। সহজে বুঝতে ধরুন, আপনি আপনার একটি ছেলে আছে মাত্র। আপনি ১০০ টাকা রেখে মারা গেলেন, আপনার উত্তরাধিকার হিসেবে শুধু আপনার একটিমাত্র ছেলেটি আছে, তাহলে সে কত টাকা পাবে?- অবশ্য ১০০ টাকার পুরোটাই। কিন্তু আপনি যদি দুটো ছেলে রেখে মারা যান সে ক্ষেত্রে তারা কত টাকা পাবে?- সে ক্ষেত্রে তারা ১০০ টাকাকে দু’জনে সমান ভাগে ভাগ করে নেবে; অর্থাৎ একজনে ৫০ টাকা করে পাবে। কিন্তু ধরুন আপনার দুই সন্তানের মধ্যে এক সন্তান জীবিত থাকে আরেকজন মৃত, তাহলে আপনার জীবিত এক সন্তান তখন আপনার ১০০ টাকা পুরোটা পাবে (লা ওয়ারিশ প্রথা বাতিলের বিষয়টি ব্যতিক্রম)। স্ত্রীর ক্ষেত্রেও একই উদাহরণটা আপনাকে মাথায় রাখতে হবে। স্ত্রী একজন হোক আর একাধিক হোক, চার ভাগের এক ভাগ বা আট ভাগের এক ভাগ, এক বা একাধিক স্ত্রীদের জন্যই বরাদ্দ। একজন হলে তো পুরোটাই পাচ্ছে আর যদি একাধিক হয় তাহলে তারা একজন হলে যা পেতো, তখন সকলে মিলেই তা সমান ভাগে ভাগ করে নিবে। ১/৪ বা ১/৮, একাধিক স্ত্রী তাদের নিজেদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে নিবে, এমন নয় যে তারা প্রত্যেকেই আট ভাগের এক ভাগ বা চার ভাগের এক ভাগ করে পাবেন; বরং প্রত্যেকে মিলে ১/৪ বা ১/৮ অংশ পাবে।
অর্থাৎ, মৃত ব্যক্তির যদি সন্তান থেকে থাকে তাহলে স্ত্রী যদি একাধিক হয় তাহলে তারা প্রত্যেকেই আট ভাগের এক ভাগ অংশ থেকে তারা প্রত্যেকে নিজেদের মধ্যে সমান ভাগ করে নেবে। এখন কথা হচ্ছে, স্বামী যখন মারা গেল তখন একাধিক স্ত্রীর মধ্যে যারা জীবিত, শুধুমাত্র তারাই উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাবে। প্রথম স্ত্রী মারা গিয়ে থাকলে তাহলে দ্বিতীয় স্ত্রী শুধুমাত্র সম্পত্তিটুকু পাবে। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার কারণে তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে কোন সম্পত্তি পাবেন না। ঠিক তেমনি প্রথম স্ত্রী জীবিত অবস্থায় যদি দ্বিতীয় স্ত্রী মারা গিয়ে থাকে, তারপরে গিয়ে যদি স্বামী মৃত্যুবরণ করে সেই ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রথম স্ত্রী স্ত্রীর অংশটুকু একাই পাবে, দ্বিতীয় স্ত্রী মারা যাওয়ার কারণে তিনি কোন অংশ পাবেন না। এক্ষেত্রে প্রত্যেক ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, মৃত ওয়ারিশ কখনো উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পায় না। সেটা শুধুমাত্র লা ওয়ারিশ প্রথার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম; অন্য জায়গায় একই বিষয় প্রযোজ্য। স্বামী স্ত্রীর অধিকার এর আরেকটি জটিলতা আমাদের সমাজে রয়েছে যে আমাদের দেশে বিয়ের সময় পুরো দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করা হয় না। কিছু টাকা বাকি রেখে দেওয়া হয়। টাকা বাকি থাকা অবস্থাতেই অনেক স্বামী মৃত্যুবরণ করে, যার ফলে স্ত্রী যদি তার বকেয়া দেনমোহরের টাকা দাবি করে, সেক্ষেত্রে সমাজে তাকে অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে। কিন্তু এটি তার বৈবাহিক হক, কোন স্বামী যদি তার স্ত্রী দেনমোহরের টাকা পরিশোধ না করে মারা যায়, সেই ক্ষেত্রে ওই স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে প্রথমে স্ত্রীর দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হবে, তারপরে গিয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টন করতে হবে। কোনমতেই দেনমোহরের টাকা উত্তরাধিকারকে বাধাগ্রস্ত করবে না। ঠিক তেমনি উত্তরাধিকারের হক ও দেনমোহরের টাকা কে বাধাগ্রস্ত করবে না। এক্ষেত্রে দেনমোহরের টাকা কে অন্যান্য পাওনা টাকা পরিশোধের মত আগে পরিশোধ করতে হবে, তারপর গিয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টন করতে হবে।
আশা করি, মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রী বা স্ত্রীগণদের উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির অধিকার সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ থাকছে না। তারপরও কারো কোন প্রশ্ন, অভিযোগ বা পরামর্শ থাকলে আমাদেরকে ইমেইল করে জানাতে পারেন।
ধন্যবাদ।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )