হেবা দলিল

পুরো সম্পত্তি সন্তানদের হেবা করার পর নতুন সন্তানের জন্ম

উত্তরাধিকার আইন

দুই সন্তানের বেশি নয় একটি হলে ভালো হয়। পরিবার পরিকল্পনার জন্য সরকারের এই স্লোগান মেনে সুমন এবং আঁখি তাদের দাম্পত্য জীবনে দুটি সন্তানই জন্মদান করেছিল। বিপত্তির বিষয় হচ্ছে, দুটোই কন্যা সন্তান হিসেবে জন্ম নেওয়ায় তাদের মধ্যে সব সময় তাদের অর্জিত সম্পত্তিদের উত্তরাধিকার নিয়ে একটি দুশ্চিন্তা কাজ করতো।

কারণ, আমরা জানি যে মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুসারে শুধুমাত্র কন্যা সন্তান থাকলে সেক্ষেত্রে সম্পত্তির কিছু অংশ বাহিরে চলে যায়। একটি কন্যা সন্তান থাকলে ঐ কন্যা সন্তান তার পিতা-মাতার সম্পত্তির অর্ধেক অংশের মালিকানা অর্জন করে, বাকি অংশ চলে যায় তার চাচা বা চাচাতো ভাইদের কাছে। অন্যদিকে যদি দুই বা ততোধিক কন্যা সন্তান থাকে সেক্ষেত্রে তিন ভাগের দুই ভাগ অংশ, অর্থাৎ ৬৬.৬৬% সম্পত্তি কন্যা দ্বয়ের মধ্যে থাকে, বাকি অংশটি বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

 

সম্পত্তি যাতে বাহিরে চলে না যায় এজন্য আমাদের দেশে অনেক অভিনব উপায় অবলম্বন করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে শুধুমাত্র কন্যা সন্তান থাকলে সম্পত্তি যাতে ভাই বা ভাতিজাদের কাছে চলে না যায় সেক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা সম্পত্তি মেয়েদের নামে হেবা করে দিয়ে থাকে।

আমাদের উপরিউক্ত কল্পিত গল্পে সুমন এবং আঁখি তাদের সকল সম্পত্তি তাদের দুই কন্যার নামে হেবা করে দিয়েছিল। উল্লেখ্য, তাদের বড় কন্যার বয়স ১৫ বছর এবং ছোট কন্যার বয়স ১০ বছর। যেহেতু মৃত্যুর কোন নিশ্চয়তা নেই, সেজন্য যাতে সম্পত্তি বাহিরে চলে না যায় তাই তারা জীবিত অবস্থায় দুই কন্যাকে তাদের সমুদয় সম্পত্তি লিখে দিয়েছিল।

কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে অসাবধানতার কারণে হোক আর অন্য যেকোনো কারণেই হোক হঠাৎ ঐ দম্পতি আরেকটি সন্তান জন্মদান করে এবং পরবর্তীতে দেখা যায় যে ঐ সন্তানকে কোন সম্পত্তি দেওয়ার বা রেখে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেননা সমুদয় সম্পত্তি ইতিমধ্যে প্রথম দুই কন্যার নামেই হেবা করে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে তৃতীয় সন্তান হোক সে ছেলে কিংবা মেয়ে, তাকে কিভাবে সুমন এবং আঁখি দম্পতি সম্পত্তিতে অংশীদারি করতে পারে?

 

এক্ষেত্রে দুটো সমাধান রয়েছে, প্রথম সমাধান হচ্ছে আমরা জানি যে হেবা দলিল সাধারণত বাতিল করা যায় না। কিন্তু হেবার একটি শর্ত হচ্ছে, হেবা গ্রহীতার বরাবরে দখল স্থানান্তর করতে হবে। এক্ষেত্রে সুমন এবং আঁখি দম্পতি তাদের দুই কন্যাদ্বয়কে সম্পত্তি হেবা করে দিলেও সে সম্পত্তি হস্তান্তর করেনি। ঐ সম্পত্তির দখল তখনো ঐ দম্পতির কাছেই ছিল। সেক্ষেত্রে তারা আদালতে হেবা বাতিল করে নতুনভাবে তিন সন্তানের জন্যই নতুন হেবা করতে পারে; তবে এটি করতে হবে অবশ্যই আদালতের মাধ্যমে। আদালতের মাধ্যমে হেবার দলিল বাতিল করে বা সম্ভব হলে হেবা দলিল সংশোধন করে, তৃতীয় সন্তানকে সম্পত্তিতে অংশীদার করা যাবে।

মনে রাখবেন, দলিল আদালত ব্যতীত সংশোধন করা যায় না। আর, অতি চালাকি করে অনেকেই ইতিমধ্যে হয়ে যাওয়া হেবা দলিল গোপন রেখে নতুন করে আরেকটি হেবা দলিল করবে, যেখানে তিন সন্তানকে সম্পত্তি দেওয়া হবে; সেটিও ঠিক হবে না। কেননা, একই বিষয়ে যদি একাধিক দলিল থাকে সেক্ষেত্রে প্রথম দলিলটিই কার্যকর হবে। তাই, কারো কথায় এসব চালাকি না করে প্রথম দলিলটি বাতিল করে তারপরই নতুন আরেকটি দলিল করে সম্পত্তি হস্তান্তর করতে হবে।

 

আদালতের মাধ্যমে হেবা দলিল বাতিল করা সম্ভব না হলে বা অর্থ/সময় সাপেক্ষ হলে দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে, নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি করা বা হস্তান্তর করার ক্ষেত্রে নাবালকের পিতার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে। যেহেতু নাবালকের স্বাভাবিক অভিভাবক হচ্ছে পিতা এবং আদালতের কোন অনুমতি ছাড়াই পিতা নাবালকের সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন, সেক্ষেত্রে যদি সুমন এবং আঁখি দম্পতি তাদের সম্পত্তি তাদের বড় দুই কন্যাকে দিয়ে থাকে, ঐ সম্পত্তি উনারা পুনরায় বিক্রি বা অন্য যে কোন উপায়ে তিন সন্তানের নামে সমুদয় সম্পত্তির তিন ভাগের বা যদি তাদের ছেলে সন্তান হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে অর্ধেক সম্পত্তি ঐ ছেলের নামে হস্তান্তর করতে পারে। তবে, পিতার পরিবর্তে মাতা হলে, সেক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি লাগবে। মাতা কখনোই নাবালকের সম্পত্তি আদালতের অনুমতি ব্যতীত হস্তান্তর করতে পারেন না।
তবে মাথায় রাখতে হবে, দ্বিতীয় উপায় অপেক্ষা প্রথম উপায় সর্বোপরি উপযুক্ত। আদালতের মাধ্যমে হেবা দলিল বাতিল করে নতুন করে তিন সন্তানের জন্য হেবা করা উত্তম।

 

উপরের কল্পিত ঘটনার বাহিরেও অনেক ধরনের ঘটনায় এমনও দেখা যায় যে, প্রথম সংসারের সকল সন্তানকে সম্পত্তি হেবা করে দেওয়ার পর প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার কারণে দ্বিতীয় বিবাহ করতে হয়। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় সংসারেও যদি কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করে এবং তাদের জন্য কোন সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকে না, সেই ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়ায় সকল সন্তানদের মধ্যে হেবা করা যেতে পারে।

বিপত্তি হবে একটাই যদি এর মধ্যে কোন সন্তান সাবালকত্ব অর্জন করে এবং সে ঐ সম্পত্তি নিজের হাতছাড়া করতে না চায়। কেননা সন্তান সাবালক হয়ে গেলে সে চাইলের নিজের সম্পত্তি দখল নিতে পারে আর সাবালক হওয়ার ফলে পিতা সরাসরি কিংবা মাতা আদালতের অনুমতি নিয়ে সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারবেন না।

 

তাই, সন্তানকে বা যে কাউকে সমূদয় সম্পত্তি হেবা বা দান করার পূর্বে চিন্তা করতে হবে এর ফলাফল নিয়ে। উইল বা অছিয়ত হচ্ছে এর মধ্যে সবচেয়ে সহজ উপায়, হেবা যেখানে তাৎক্ষণিক মালিকানা হস্তান্তর হয়ে যায় সেখানে উইল বা অছিয়ত আপনার মৃত্যুর পর কার্যকর হবে। তবে, সমস্ত সম্পত্তি হেবা করা গেলেও উইল করা যায় মোট সম্পত্তির মাত্র ১/৩ অংশ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.