আমরা দুনিয়াতে আজকে প্রায় ৭০০/৮০০ কোটি মানুষ, যাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল মাত্র ২ জন মানুষ থেকে; বাবা আদম এবং মা হাওয়া । আমরা আজকে ৭০০/৮০০ কোটি হলেও আমাদের আগে কি কম মানুষ এসেছিল দুনিয়াতে? তাদের সকলের শুরুটাই কিন্তু আদি পিতা-মাতা থেকে। এবার একটু ভাবুন, যখন আদি পিতা-মাতা পৃথিবীতে এলেন, তখন গোটা পৃথিবীর মালিকানা ছিল ওনাদের দুজনের আর সেটা ছিল দখল স্বত্তের ভিত্তিতে। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন আমাদের আদি পুরুষদের জন্ম হতে লাগলো তখন কিন্তু পৃথিবীতে দখলদার বাড়তে শুরু করলো এবং এবং জমির ভাগ বাটোয়ারাও শুরু হতে লাগলো। যদিও তখন এই বিষয়গুলো আমাদের বর্তমান সময়ের মত ছিল না, ছিল না তখন মাপজোখ, কাগজপত্র। তবে ভাগ বণ্টনের বিষয়টা বেশ পুরনো। যদিও অনেকেই দ্বিমত করবে এই থিউরিতে যে, জমির মালিকানা এক সময় জনগণের নিকট ছিল না, ছিল ক্ষমতাধর তথা রাজার কাছে। তবে, রাজা তো আর পুরো জমি দখল করে বসে থাকতেন না। তিনি বরং প্রতীকী মালিকানায় ছিলেন। বসবাস, চাষবাসের জন্য জমির দখল সেই ঘুরেফিরে জনগণের নিকটই ছিল। লীজ তথা ইজারার ভিত্তিতে তখন কৃষক বা সকল শ্রেণীর প্রজারা জমির দখলে ছিলেন। সেই দখল থেকেই রায়তী, সিএস রেকর্ডের ভিত্তিতেই আজকের আমাদের দেশের এত জমির মালিকানা। এই জমির মালিকানা আমরা পরিবর্তন করেছি প্রয়োজনের তাগিদে বিক্রির মাধ্যমে, মৃত্যুর পর ওয়ারিশদের মাঝে, আর কিছু অসাধু জোর জবর দখলের মাধ্যমে, যাই হোক, মালিকানা যেভাবেই হস্তান্তর হোক বা যেভাবেই মালিকানা সম্পত্তি অর্জন হোক না কেন, যৌথ মালিকানা সম্পত্তি যখন একের অধিক ব্যক্তির মিলেমিশে ব্যবহার করে, ভোগ দখল করে, তখন সেই সম্পত্তিকে এজমালি সম্পত্তি বলা হয়।
এজমালি সম্পত্তি কখনো না কখনো একক মালিকের মালিকানাধীন ছিল। আপনি এখন যে জমির মালিক, আপনার মৃত্যুর পর আপনার সন্তান সন্তানির মাঝে যখন উক্ত সম্পত্তি বণ্টন করা হবে, তখন তারা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা ভাবে নিজ নামে সম্পত্তি বণ্টন করে নিবে। এই বণ্টন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত উক্ত সম্পত্তিকে বলা হবে এজমালি সম্পত্তি যা সকলের জন্য উন্মুক্ত। সকল বলতে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের বুঝানো হবে। এখন এজমালি সম্পত্তি সবাই ভোগ দখল করলেও সেখানে তৈরি হয় নানা বিপত্তি। মানুষ সামাজিক জীব, মানুষ একাকী বসবাস করতে পারে না, সমাজবদ্ধ ভাবে বসবাস করতে হয়। কিন্তু এটাও সত্য মানুষ মাত্রই স্বার্থপর, স্বার্থে আঘাত আসলেই সামাজিক জীবের অসামাজিক কর্মকাণ্ড করতে দ্বিধা বোধ হয় না। তখনি শুরু হয় এজমালি সম্পত্তিতে যে যার মত দখল বা সুবিধা মত জায়গা সিলেকশন করে অন্যকে ঠকানোর ধান্দা। তাছাড়া একটি গ্রাম্য প্রবাদ রয়েছে “ভাই যেদিন ভাগ সেদিন” অর্থাৎ আজকে আপনার ভাই হয়েছে তো আজকেই আপনার বাবার সম্পত্তিতে আপনার এবং আপনার ভাইয়ের মাঝে ভাগ শুরু হয়ে গেছে। আর মানুষও এই থিওরি গুলো প্রমোট করে সম্পত্তি বণ্টন পদ্ধতিকে সহজলভ্য স্বাভাবিক বানিয়ে নিয়েছে। যদিও এজমালি সম্পত্তিতে যৌথ আবাসন প্রস্তুত করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জমি যেমন রাখা সম্ভব, তেমনি পারস্পরিক মায়া মমতা, ভালোবাসাও ধরে রাখা সম্ভব। যাই হোক, আরেকটা প্রবাদ আছে, “সুখে থাকলে ভূতে কিলায়” এ প্রবাদের ভিত্তিতেই বেশিরভাগ মানুষ মিলেমিশে থাকতে পারে না। যৌথ পরিবারের চেয়ে একক পরিবারে বেশি সুখের আশায় যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবারে আসে, এসে দেখে “জ্বলন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় এসে পড়েছে”।
এখন যে যাই বলুক, এজমালি সম্পত্তি বণ্টন করতে হবে; এটাই যখন ফাইনাল, তখন কি করতে হবে সেটা নিয়ে আসুন কথা বলি। ধরুন, আপনার বাবার মৃত্যুর পর আপনার ৩ ভাই বোনের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টন করতে হবে। ধরুন আপনার ২ ভাই ১ বোন। আপনার বাবার মৃত্যুতে এজমালি সম্পত্তিকে আপনারা আপনাদের ইচ্ছেমত সকলের সম্মতিতে বণ্টন করতে পারেন, আবার কেউ কাউকে না মানলে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। কোনটা ভালো? শেষ পর্যন্ত একটা কথাই বলে যাবো যে, একদমই কোন উপায় না পেলে কেবলমাত্র তখনি আদালতে যাবেন, এর আগে নয়। বিশ্বাস না হলে খবর নিয়ে জেনে নিন, শেষ কবে কেউ বাটোয়ারা মামলা করে দুই-চার বছরের মধ্যে রায় পেয়েছে? আর বাটোয়ারা মামলায় যেহেতু ভাই বোন সবাইকে পক্ষ হতে হয়, আবার, ভাই বোন কারো মৃত্যুতে তার ওয়ারিশদের পক্ষ করতে হয়। সেহেতু মামলা করলে আদালতে আসা যাওয়াতেই যে খরচ হবে সেটাই হিসেব করে দেখলে অবাক হবেন। অথচ আপোষে নিজেরা বণ্টন করে নিলে কোনপ্রকার বাড়তি খরচ ছাড়া মাত্র ২৭৬০/- টাকা বা তার চেয়ে কিছু বেশি অর্থ পরিশোধ করে আপনারা সাব রেজিস্ট্রি অফিসে বাটোয়ারা সম্পন্ন করতে পারেন। অথচ, আপনি আপনার বাসা থেকে ৪ জন মানুষ নিয়ে বছরে ১২ বার আদালতে উপস্থিত হতেই তার চেয়ে বেশি টাকা যাতায়াত খরচ দিতে হবে, উকিল খরচ বাদই দিলাম। তাছাড়া এখন করোনা পরিস্থিতিতে আদালত এই খুলে তো এই বন্ধ হয়। সেখানে আপনি কয় বছর লাগিয়ে রায় পাবেন, তা আরও অনিশ্চিত। কিন্তু আপোষে বণ্টন করে নিলে দিনে দিনেই সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে বণ্টন দলিল সম্পন্ন করে নিজ নিজ নামে জমা খারিজ করিয়ে নিতে পারবেন।
আর মামলা মানেই হচ্ছে, মিথ্যা কথা আর অপবাদের ছড়াছড়ি। ভাই-বোনের মাঝে বাটোয়ারা মামলা হলেও দেখবেন সম্পর্ক তিক্ত থেকে তিক্ততর হয়ে গেছে। অথচ, আপোষে বণ্টন হলে, একে অন্যকে ছাড় দিয়ে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রেখে ঝামেলা এড়ানো সম্ভব। তাই, সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন আপোষে বণ্টন করতে।
আপোষে বণ্টন করতে না পারলে শেষ পর্যন্ত আদালতে গিয়ে বাটোয়ারা মামলা করতে হবে৷ মৃত ব্যক্তির মৃত্যু সনদ, ওয়ারিশান সনদ এবং সম্পত্তির কাগজপত্র ইত্যাদি৷ তখন আদালত প্রয়োজনে কমিশন গঠন করে হলেও সম্পত্তি বাটোয়ারা করে দিবেন, যদিও সেটা বেশ সময় সাপেক্ষ।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )