কি?
কোন সম্পত্তি ভবিষ্যতে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে সম্পত্তির মূল্য বাবদ আংশিক অর্থপ্রাপ্তির প্রদানের মাধ্যমে পক্ষগণের মধ্যে বর্তমানে যে চুক্তি করা হয় তাকে বায়না পত্র বা বায়নানামা বলে। আইনের ভাষা বা বইয়ের ভাষা বুঝতে একটু জটিলতা সৃষ্টি হলেও বিষয়টা আসলে ততটা রকেট সায়েন্স নয়। সাধারণত, একটি সম্পত্তি বিক্রির সবচেয়ে সহজ এবং প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে, বিক্রেতা বিক্রি করবে আর ক্রেতা ক্রয় করবে; মাঝখানে বিনিময় হবে সম্পত্তি আর টাকা পয়সা। এখন বিশ্বাস অবিশ্বাসের ব্যাপার যেহেতু রয়েছে তাই এক হাতে টাকা, অন্য হাতে সম্পত্তি আদান প্রদানের প্রচলনটাই নিরাপদ। কিন্তু, যখন টাকার পরিমাণটা বেশী হয় এবং সম্পত্তি হস্তান্তর তাৎক্ষণিক সম্ভবপর নয়, তখন উভয়ের সম্মতিতে আংশিক টাকা পরিশোধ করে একটি প্রাথমিক দলিল করে বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিতের পাশাপাশি মূল হস্তান্তরকে এগিয়ে নেওয়ার দালিলিক বিষয়টিই হচ্ছে মূলত বায়নাপত্র বা বায়নানামা বা বায়না দলিল।
কেন?
অর্থের লেনদেন হয় না যেসব স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের বেলায় যেমন হেবা, দান, ওয়াকফ, উইল ইত্যাদি দলিলের ক্ষেত্রে যেহেতু আর্থিক কোনো লেনদেন হয় না, সেক্ষেত্রে বায়না দলিলের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু যেসব দলিলের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের বিষয় রয়েছে সেইসব দলিলের ক্ষেত্রে বায়না দলিলের প্রয়োজনীয়তা অনেক। যদিও একটি সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দলিল রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে বায়না দলিল আবশ্যক নয়। কিন্তু বায়না দলিল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিক্রেতা এবং উভয়ের জন্যই উপকারী মাধ্যম। কেননা আমরা যখন একটি সম্পত্তি ক্রয় করতে যাই, তখন উক্ত জমির মূল্য পরিশোধ করেই আমরা সাফ কবলা দলিল রেজিস্ট্রেশন করে থাকি; যেখানে জমির মূল্য আমাদের অনুকূলে থাকে। কিন্তু সব সময় যে জমির মূল্য আমরা একবারে পরিশোধ করতে পারব বা পারছি, তা কিন্তু নয়। কখনো কখনো আমাদেরকে জমির মূল্য আংশিক করে করে কিস্তি বা ইন্সটলমেন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু বিক্রেতা যাতে আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পরবর্তীতে ওই টাকা দিতে অস্বীকার কিংবা ওই জমি বিক্রি করতে অস্বীকার করতে না পারে, সেই কারণে যে আংশিক টাকা আমরা ক্রেতা হিসেবে বিক্রেতাকে পরিশোধ করেছি, তখন একটি বায়নাপত্র দলিল এর মাধ্যমে তা রেজিস্ট্রেশন করে লিখিত আকারে বিক্রেতার কাছ থেকে এই মর্মে নেওয়া হবে যে, আমি নির্দিষ্ট এই সময়ের মধ্যে বাকি টাকা পরিশোধ করে জমির হস্তান্তর দলিল তথা সাফ কবলা দলিল সম্পন্ন করে নিবো আপনার কাছ থেকে এবং আপনি সেটি দিতে বাধ্য থাকবেন। যদিও দলিলের প্রেক্ষাপটে বিক্রেতা নিজেই ঘোষণা দিয়ে থাকেন যে, এই জমি আমি বিক্রি করার উদ্দেশ্যে ক্রেতার সাথে বায়নাপত্র দলিল করলাম এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্রেতা বাকি টাকা পরিশোধ করলে আমি সাব কবলা দলিল রেজিস্ট্রেশন করে দিতে বাধ্য থাকিব। এখানে নির্দিষ্ট সময়ের বিষয়টি দুই পক্ষ বসে ঠিক করতে পারবে তাদের উভয়ের সম্মতিতে। কিন্তু, যদি কোন সময় উল্লেখ না থাকে তাহলে বায়না দলিল রেজিস্ট্রেশনের দিন থেকে ৬ মাসের মধ্যে সাফ কবলা দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে হবে; ধারা ৫৪(ক), সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ১৮৮২। যাই হোক, এই বায়নাপত্র দলিলের মাধ্যমে ক্রেতা যেমন তার অগ্রিম টাকা পরিশোধের নিশ্চয়তা পেয়ে থাকেন, তেমনি বিক্রেতাও অন্য কোথাও জমি বিক্রি করে ক্রেতাকে বিপদে ফেলতে পারার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। তাছাড়া জমির মূল্য যখন অনেক বেশি থাকে ক্রেতা একবারে পরিশোধ করতে সক্ষম থাকেন না, তখন কিছু টাকা অগ্রিম পরিশোধ করে জমি ক্রয় করার অধিকার অর্জন করে কিছু সময় হাতে পেয়ে থাকেন যাতে বাকি টাকা পরিশোধ করতে পারেন। সর্বোপরি বায়নাপত্র দলিল ক্রেতার টাকার সুরক্ষার জন্যই এবং জমি ক্রয় করার অগ্রাধিকার অটুট রাখার জন্য ক্রেতার পক্ষে উপকারী হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
কিভাবে?
এবার আসুন আমরা জানবো কিভাবে একটি বায়নাপত্র দলিল করতে হবে। আপনি আমার কাছ থেকে একটি জমি ক্রয় করবেন, বর্তমানে আপনার কাছে পুরো জমির মূল্য পরিশোধ করার সামর্থ্য নেই। আপনি আংশিক মূল্য, সেটি অর্ধেক হতে পারে বা যেকোনো পরিমাণের হতে পারে, তবে উভয়ের সম্মতিতে যে মূল্য পরিশোধ করতে চাচ্ছেন, তা উল্লেখ করে আমরা একটি দলিল করতে পারি। সচরাচর আমরা দেখে থাকি একজন আইনজীবীর মাধ্যমে বা কখনও কখনও নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এবং সবচেয়ে বেশি (গ্রাম অঞ্চল) দলিল লেখকের মাধ্যমে বায়নাপত্র দলিল সম্পাদন করা হয়ে থাকে। এখানে সম্পাদন বলতে দলিল লেখার বিষয়টাকে বুঝানো হয়েছে। একটি দলিল সম্পাদন করা মানেই কিন্তু ওই দলিলের ভিত্তিতে সকল আইনি অধিকার সৃষ্টি হয়ে গেছে তা কিন্তু নয়। দলিল রেজিস্ট্রেশন না করলে এই দলিলের বিপরীতে আপনার যত ধরনের আইনি অধিকার রয়েছে তা আপনি দাবি করতে পারবেন না। তাই একটি বায়নাপত্র দলিল সম্পাদনের ৩০ দিনের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে এবং এটি বাধ্যতামূলক; রেজিস্ট্রেশন আইনের ১৭(ক) ধারা অনুসারে।
অর্থাৎ আপনাকে বায়নাপত্র দলিলটি দলিল লেখক বা আইনজীবীর মাধ্যমে সম্পাদন করার পরে ৩০ দিনের মধ্যে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে রেজিস্ট্রেশন করে নিতে হবে। উল্লেখ্য অনেকেই কোন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রেশন করবেন এই নিয়ে অনেক সময় দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন। ক্রেতা যেখানে থাকে সেখানে, নাকি বিক্রেতা যেখানে থাকে সেখানে?
এখানে মনে রাখতে হবে স্থাবর সম্পত্তি অর্থাৎ যে জমিটি নিয়ে আপনাদের মাঝে বায়নাপত্র হচ্ছে সেই জমিটি যেই সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের আন্ডারে/ এরিয়ার আওতাভুক্ত, সেই সাব রেজিস্ট্রি অফিসে আপনাকে বায়নাপত্র দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এটি সকল প্রকার হস্তান্তর দলিলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
এবার আসা যাক খরচাপাতি নিয়ে। আমাদের দেশে রেজিস্ট্রেশন করতে যে একটি খরচ বহন করতে হয় অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন ফি, যা দেওয়ার ভয়ে আমরা অনেক সময় বায়নাপত্র দলিলের মত অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ(অবস্থা ভেদে এটি মহা গুরুত্বপূর্ণও হয়ে উঠে) দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে অনীহা পোষণ করি। অথচ, আপনি জানলে অবাক হবেন যে, একটি বায়নাপত্র দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে সরকারি খরচ খুবই সামান্য বলা চলে নামমাত্র। আপনার জমির মূল্য যদি ৫ লক্ষ টাকার বেশী না হয়ে সেই ক্ষেত্রে আপনাকে মাত্র ৫০০ টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি পরিশোধ করতে হবে। আবার আপনার জমির মূল্য যদি ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আপনাকে রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হবে ১০০০ টাকা, সবশেষে জমির মূল্য ৫০ লক্ষ টাকার বেশি হলে আপনাকে রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হবে ২০০০ টাকা।
বায়না কৃত জমির মূল্য | বায়না দলিলের রেজিস্ট্রেশন ফি |
অনধিক ৫ লক্ষ টাকা | ৫০০ টাকা |
অনধিক ৫০ লক্ষ টাকা | ১০০০ টাকা |
৫০ লক্ষ টাকা থেকে আনলিমিটেড | ২০০০ টাকা |
আজকে এতটুকুই, পরবর্তী একটি আর্টিকেলে আমরা একটি বাস্তব বায়না দলিল দিয়ে দলিলের খুঁটিনাটি দেখানোর চেষ্টা করবো, পাশাপাশি বায়না দলিল বাতিল এবং বলবত সংক্রান্ত আইন নিয়েও আলোচনা করবো।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )