৩০/৪০ বছর পর পর আমাদের দেশে সরকারিভাবে ভূমি জরিপ করতে সার্ভেয়ার বা আমিনদেরকে পাঠানো হয়ে থাকে। যখন সার্ভেয়ার বা আমিন এসে থাকে বা বলা চলে যখন সরকারি জরীপ কার্য পরিচালিত হয় তখন প্রত্যেক জমির মালিক তার জমিতে অবস্থান করে এই কথাটা বলা ভুল হবে। যাকে যেভাবে দখলে পাচ্ছে তাকে সেভাবে রেকর্ডে উল্লেখ করছে। কিন্তু, সবাইকে কি সরেজমিনে দখলে পাচ্ছে?- না। কেননা আমরা কাজের সুবাদে নিজের জেলা থেকে অন্য জেলায় থাকতে পারে, এমনকি এক দেশ থেকে অন্য দেশেও থাকতে পারি। তাছাড়া আমাদের জমি যে শুধুমাত্র এক জেলায় থাকবে, তাও কিন্তু নয়। অনেকের গ্রামের বাড়িতে ও জমি রয়েছে আবার কর্মস্থল যদি ঢাকা-চট্টগ্রাম হয়ে থাকে ওইখানে ও তার নামে জমি রয়েছে। এখন কোন একটি জমিতে উনি অবস্থান করতে না পারার কারণে ভূমি জরিপ কালে ওনার ওই জমিটি ভুলে আরেকজনের নামে উঠে গেছে। এমনও হতে পারে যে ভূমিতে অবস্থান করা সত্বেও শুধুমাত্র ভূমির হিসেবে অজ্ঞতার কারণে নিজের জমি অন্যের নামে উঠে যেতে পারে। আবার ভূমির পরিমাণ সংক্রান্ত যে বিষয়টি সেখানে গরমিল হতে পারে; আপনার জমির পাশে আপনার প্রতিবেশী একটি জমি রয়েছে, আপনার জমি ৫০ শতক আপনার প্রতিবেশীর জমি ৩০ শতক, কিন্তু দেখা গেল যে রেকর্ড করার সময় ভুলে আপনার নামে ৩০ শতক উঠে গেছে আর আপনার প্রতিবেশীর নামে ৫০ শতক উঠে গেছে বা আপনার নামে ৪০ শতক আপনার প্রতিবেশী নামে ৪০ শতক সমান সমান ভাবে রেকর্ড করে সার্ভেয়ার বা আমিন চলে গেছে। সেই ক্ষেত্রে আপনি কিভাবে আপনার জমির রেকর্ড সংশোধন করবেন?
যেহেতু সরেজমিনে রেকর্ড করে খতিয়ান এবং নকশা তৈরি হয়, তাহলে খতিয়ান এবং ম্যাপ দুই জায়গাতেই আপনার জমির রেকর্ড ভুল আসবে। এখন আপনার ক্ষতি হচ্ছে গিয়ে, আপনি ওই জমিতে ভোগ দখলে ঝামেলায় পড়বেন। বিক্রি করতে গেলে পুরো জমি বিক্রি করতে পারবেন না, রেকর্ডে যা উঠেছে তা বিক্রি করতে হবে। নানা প্রকারের জটিলতায় জর্জরিত হতে হবে। এখন কথা হচ্ছে, কিভাবে আপনার জমি আপনার প্রতিবেশীর নামে রেকর্ড হয়ে গেলে তা আপনি পুনরায় আপনার নিজের নামে রেকর্ড করাবেন?
এই ক্ষেত্রে প্রথমেই বলে রাখি ভূমি, জরিপের সময় সর্বদা চেষ্টা করবেন নিজের এলাকায় যখন জরিপ হচ্ছে তখন নিজে উপস্থিত থাকা। নিজে একান্ত উপস্থিত থাকতে না পারলে নিজের প্রতিনিধি কাউকে উপস্থিত রাখা, সেটাই ছেলে/ভাই হতে পারে বা এমন কাউকে দায়িত্ব দিয়ে আসতে হবে সাথে আপনার অতীতের যে কাগজপত্র রয়েছে সেই কাগজপত্রগুলো প্রতিনিধির মাধ্যমে জরীপ কার্য পরিচালনার সময় আমিন বা সার্ভেয়ারদেরকে দেখিয়ে নিজের জমির সঠিক রেকর্ড করাবেন। তারপরেও ধরে নিলাম যেকোনো কারণেই বর্তমানে বা অতীতে আপনার জমির রেকর্ড ভুল উঠেছে। সেই ক্ষেত্রে সার্ভেয়ার বা আমিন রেকর্ড করে যাওয়ার সময় একটি পর্চা দিয়ে যায়, সেটাকে খতিয়ানের খসড়া হিসেবে ভূমির মালিককে দিয়ে যায়, যাতে সেখানে কোন ভুলত্রুটি থাকলে ৩০ দিনের মধ্যে সেটেলমেন্ট অফিসে জানিয়ে সংশোধন করার সুযোগ দেওয়া হয়। আপনার জমির পর্চায় কোন ভুল থাকলে সেটা সংশোধন যোগ্য হলে অবশ্যই তারা সংশোধন করে দিবেন। এখন ধরে নিন, আপনার সেটেলমেন্ট অফিসে যাওয়া জন্য বেঁধে দেওয়া ৩০ দিনের সময় পার হয়ে গেছে। আপনার জমি আরেকজনের নামে রেকর্ড হয়ে বসে আছে, এখন এই ক্ষেত্রে আপনি কি আদালতে মামলা করবেন?- আদালতে মামলা করা মানে অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার এবং আইনজীবীর খরচ, নিজের যাতায়াত খরচ, বিবাদীদেরকে নিয়ে অনেক খরচ, সেক্ষেত্রে একটি সহজ উপায় হচ্ছে, যেই ব্যক্তি ভূমির মালিক নয় কিন্তু ভুলে তার নামে উঠে গেছে আগে আপনি তার সাথে সমঝোতা করার চেষ্টা করুন। সে যদি ভাল মানুষ হয়ে থাকে, পরকালের চিন্তা থেকে থাকে তাহলে সে অবশ্যই স্বীকার করবেন যে, উক্ত জমির মালিক সে নয়, সে জমির মালিক আপনি, সেক্ষেত্রে সে যদি সম্মতি দেয় যে, আমি আপনার জমি আপনাকে ফেরত দিয়ে দিব। সেক্ষেত্রে আপনি আদালতে মামলা করে সময়, অর্থ, শ্রম নষ্ট না করে এই ব্যক্তির কাছ থেকে খতিয়ানমূলে মালিক, এইভাবে একটি সাফ কবলা দলিল করে উনার কাছ থেকে যতটুকু জমি ওনার নামে ভুলে উঠে গিয়েছিল ততটুকু জমি উনি আপনার কাছে বিক্রি করে দিবেন। এই একটা সাফ কবলা দলিল করে আপনার জমির মালিকানা আপনি ফেরত পেতে পারেন। যা কিন্তু একদিনের মধ্যেই সম্ভব।
এখন কথা হচ্ছে, দলিলের ভিত্তিতে আপনি ওনার কাছ থেকে আপনার জমি আপনি আবার ক্রয় করে নিলেন, বিষয়টা অনেকটা ঐ রকমই যে নিজের জমি নিজে আবার ক্রয় করা; তবে প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে নিজের হারিয়ে যাওয়া জমি নিজে আবার ক্রয় করা। এখন এখানে কিছু রেজিস্ট্রি খরচ রয়েছে যা সাফ কবলার ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশী হয়, তবে হিসাব করলে আদালতের মামলার মাধ্যমে সংশোধনের খরচের চেয়ে অপেক্ষাকৃত অনেক কম হবে এবং আপনার সময় বেঁচে যাচ্ছে। আপনি দিনে দিনেই চাইলে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে দলিল করে নিতে পারে কিন্তু তারপরে আপনার গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি হচ্ছে সেটি হল ঐ দলিল নিয়ে আপনি ভূমি অফিসে নিজের নামে নামজারি করে নিতে হয়। মাথায় রাখতে হবে সরকার যখন রেকর্ড করে গেল তখন সরকারি খতিয়ানে ওই ব্যক্তির নাম উঠে। এখন যেহেতু ওই ব্যক্তি মালিক, আপনি যেহেতু দলিল করে আবার আপনার কাছে মালিকানা নিয়ে এসেছেন এখন ওই দলিলটির একটি কপি জমা দিয়ে নিজের নামের নামজারি করালে সরকারি খতিয়ান থেকে ওই ব্যক্তির নাম কর্তন করে পুনরায় আপনার নামে রেকর্ড হয়ে যাবে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে আপনার কত শ্রম এবং অর্থ বেঁচে যাবে আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। আদালতের আঙিনায় দৌড়াতে দৌড়াতে আপনার জীবদ্দশায় সেটা সংশোধন হয়ে আসবে কিনা কে জানে। তার উপর যাদের নামে রেকর্ড উঠে গেছে, তাদের সাথেও আপনার সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। তারচেয়ে বড় কথা আপনার সময় এতো কম লাগবে যা হিসেব করলেই আপনি অবাক হয়ে যাবেন। অনেকেই আছে, যার নামে ভুলে জমি রেকর্ড হয়ে গেছে তা এই প্রস্তাব দিতে লজ্জাবোধ করবেন, তাকে বলবো তাহলে আগে একদিন আপনার জেলার ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে গিয়ে খবর একটা মামলা নিষ্পত্তি হতে কত যুগ সময় লাগে; তাহলেই আপনি আপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্মার্ট হতে পারবেন। অথচ সাফ কবলার মধ্যে এই কাজটি করার জন্য আপনার সর্বোচ্চ দুই মাস সময় লাগবে, সরকারি হিসাব করলে একমাসেই সম্ভব। আপনার রেজিস্ট্রি করতে একদিন সময় লাগবে, দলিলের কপি ভূমি অফিসে জমা দিয়ে নামজারির জন্য আবেদন করলে তা ২৮ দিনের মধ্যে যদি কার্যকর হয় তাহলে এক মাসের মধ্যেই সেটা সম্ভব। কিন্তু আমরা জানি ব্যস্ততার কারণে সেটা এক মাসে সম্ভব নয় তাও দুই থেকে তিন মাসের (এক বছরও যদি লাগে মন্দ কি ভাই?) মধ্যে আপনি সেটা সম্পন্ন করতে পারবেন যেখানে কিনা আপনি ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা করলে এটা কয়েক বছর লেগে যাবে। তবে বাধা একটাই সেটা হচ্ছে, যে ব্যক্তির নামে রেকর্ড উঠেছে সেই ব্যক্তি যদি স্বইচ্ছায় জমিটি আপনাকে লিখে দিতে রাজি না হলে তখন কিন্তু ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। কখনো কখনো যেই ব্যক্তির নামে উঠে গেছে সেই ব্যক্তি মৃত হলে তার সকল ওয়ারিশদেরকে আপনি এই প্রস্তাব দিয়ে দেখতে পারেন যদি রাজি হয়ে থাকে তাহলে সকলে মিলে আপনাকে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সাফ কবলা দলিল করে দিলেই আপনি পূর্বে বর্ণিত নিয়ম অনুসারে আপনার জমি আপনার নামে নামজারি করিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু, তারাও বেঁকে বসলে তখন আপনাকে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে হবে। ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালেও যদি মামলা গ্রহণ না করে তখন আপনাকে স্বত্ব ঘোষণার মামলা করতে হবে, সেই বিষয়ে না হয় ভবিষ্যতে বিস্তারিত লিখবো। আজ এই পর্যন্তই। ধন্যবাদ।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )