বাংলাদেশে খাস জমির ব্যবস্থাপনা এবং এর সঠিক ব্যবহার ও বণ্টনের বিষয়টি অনেক পুরনো সমস্যা, যা এখনো পুরোপুরি সমাধান হয়নি। এই খাস জমি বলতে সরকারি জমি বোঝায়, যা মূলত গরিব কৃষক বা ভূমিহীনদের মাঝে বণ্টন করার জন্য রাখা হয়। তবে এই খাস জমির সঠিক ব্যবস্থাপনা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে, যা কৃষি উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে খাস জমি ব্যবস্থাপনার যে পদ্ধতি রয়েছে, তা ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা নিয়মের উপর ভিত্তি করে চলে আসছে। সেই সময় ব্রিটিশ সরকার রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এবং রাষ্ট্রের আয় বাড়ানোর জন্য একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা চালু করেছিল। স্বাধীনতার পরও এই ব্যবস্থায় তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
তবে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের উভয় সময়ে খাস জমি বণ্টন এবং ব্যবস্থাপনার জন্য কিছু চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু দেশের জনসংখ্যা যেহেতু অনেক বেড়ে গেছে এবং জমি ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়েছে, তাই এই খাস জমি বা সরকারি জলাশয়গুলো কৃষক এবং মৎস্যজীবীদের মধ্যে সঠিকভাবে বণ্টন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ধনী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা প্রায়ই এই প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে, যাতে তারা নিজেরা এই জমি থেকে লাভবান হতে পারে।
খাস জমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক বিতর্ক এবং আলোচনা হলেও, এ বিষয়ে প্রশাসন বা সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশের সংবিধান বলেছে, দেশের প্রতিটি মানুষ যেন সমান অধিকার পায় এবং সম্পদ সবার মধ্যে ন্যায্যভাবে বণ্টিত হয়, এমন একটি সমাজ গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য। যদি সঠিকভাবে খাস জমির ব্যবস্থাপনা ও বণ্টন করা যায়, তাহলে বহুদিনের জমি নিয়ে চলা সমস্যাগুলোর সমাধান হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।
আরো সহজ ভাষায় বললে দাঁড়ায়, খাস জমি বলতে সেই সকল জমিকে বোঝায় যা ব্যক্তিমালিকানাধীন নয়, বরং রাষ্ট্রের মালিকানাধীন। সাধারণত এই জমি গরিব কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করার জন্য রাখা হয়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রভাবশালী গোষ্ঠী এবং ধনী ব্যক্তিরা এই জমি নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়, যা প্রান্তিক কৃষকদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।
ঔপনিবেশিক যুগের প্রভাব: ব্রিটিশ আমলে রাজস্ব আদায় এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে জমি ব্যবস্থাপনার একটি কড়া নিয়ম চালু করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পরও এই নিয়মের অনেক অংশ অপরিবর্তিত থেকে যায়, যার ফলে সাধারণ মানুষের জন্য জমি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
উদাহরণ: ধরুন, একটি গ্রামের ৫০ একর খাস জমি আছে, যা সরকারের নীতি অনুযায়ী দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে বণ্টনের কথা। কিন্তু প্রভাবশালী একটি পরিবারের মাধ্যমে ঐ গ্রামের কিছু ধনী ব্যক্তি সেই জমি নিজের নামে কাগজপত্র তৈরি করে নেয়। এতে দরিদ্র কৃষকরা জমি থেকে বঞ্চিত হয়, যা সংবিধান নির্দেশিত অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
এই জমির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং বণ্টন করতে পারলে দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে জমির মালিকানা নিশ্চিত হবে, যা তাদের আর্থিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা অর্জনে সহায়ক হবে।
‘খাস’ শব্দটি আরবি ভাষা থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হলো ‘একান্ত’, ‘বিশেষ’, ‘নির্দিষ্ট’ বা ‘ব্যক্তিগত’। বাংলার মধ্যযুগে, বিশেষ করে মুসলিম শাসনামলে, খাস জমি বলতে সেই জমিকে বোঝানো হতো যা সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং ব্যবস্থাপনায় থাকতো। এই জমি থেকে যে ভূমি রাজস্ব আদায় করা হতো, তা সরাসরি সরকারি কোষাগারে জমা হতো। এখানে কোনো মধ্যস্থতাকারী থাকতো না; সরাসরি রাষ্ট্র এবং চাষি বা রায়তের মধ্যে সম্পর্ক থাকতো।
এখানে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক: ধরুন, কোনো গ্রামের একটি জমি সরাসরি সরকারের মালিকানায় রয়েছে এবং সেই জমি থেকে সরকার রাজস্ব সংগ্রহ করে। এই ধরনের জমি হলো ‘খাস জমি’।
অন্যদিকে, জমিদারদের অধীনে থাকা জমি, যা জমিদার নিজে ব্যবহার করতেন, তাকে বলা হতো ‘খাসমহল’, এবং এই জমির জন্য কোনো ভূমি কর দিতে হতো না।
১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন:
১৯৫০ সালে, বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়, যার নাম ‘রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০’। এই আইনে বলা হয়েছে, ‘খাস জমি’ বলতে বোঝায় এমন জমি যা সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে অথবা কোনো ব্যক্তি লিজে নিয়ে কিছু সময়ের জন্য ভোগ করে। এটি স্থায়ী মালিকানা নয়।
একটি উদাহরণ দেওয়া যাক: কোনো ব্যক্তি যদি সরকারের কাছ থেকে অস্থায়ী লিজে একটি জমি নিয়ে চাষ করে, তবে সেই জমিটি ‘খাস জমি’ হিসেবে পরিচিত হবে।
বর্তমান খাস জমির সংজ্ঞা:
বর্তমানে, ‘খাস জমি’ বলতে এমন জমিকে বোঝানো হয়, যা এখনও কোনো ব্যক্তির কাছে বন্দোবস্ত হয়নি এবং যা আইন বা স্বেচ্ছায় সরকারের অধিকারভুক্ত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ কোনো জমি ফেলে রেখে চলে যায় এবং সরকার সেই জমিকে অধিকারভুক্ত করে, তখন সেই জমি খাস জমি হিসেবে পরিচিত হবে।
খাস জমির তথ্য ৮ নম্বর রেজিস্টারে কালেক্টরের নামে খতিয়ান নম্বর ১-এ লিপিবদ্ধ করা হয়। তবে, এই রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ সমস্ত জমিই বন্দোবস্তের জন্য প্রযোজ্য নয়। রেজিস্টারটি বাংলাদেশ ফরম নম্বর ১০৭২ অনুযায়ী চারটি ভাগে ভাগ করা হয়:
- ১. জনসাধারণের ব্যবহারাধিকারভুক্ত সম্পত্তি যেমন রাস্তা, পুকুর, সেতু, কূপ ইত্যাদির বিবরণ;
- ২. চাষযোগ্য খাস জমির বিবরণ;
- ৩. সরকার কর্তৃক ক্রয়, অধিগ্রহণ বা পরিত্যক্ত সম্পত্তির বিবরণ;
- ৪. নদীভাঙনে হারিয়ে যাওয়া বা নতুনভাবে সৃষ্টি হওয়া জমির বিবরণ।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, একটি নদীর তীরবর্তী এলাকা ভরাট হয়ে নতুন জমি সৃষ্টি হলো বা কোন নতুন চর জেগেছে, সেই জমিটি খাস জমি হিসেবে রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত হবে।
আজ এতটুকুই, ভবিষ্যতে আমরা খাস জমি বন্দোবস্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে লিখবো, ইনশাআল্লাহ।

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )