আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, এটা আমাদের সকলেরই ছোট বেলা থেকেই জানা, কিন্তু কেন শুধু কন্যা সন্তানকেই কবর জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, ছেলেদের কেন নয় সেটি কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি?
কন্যা সন্তানকে সেই যুগে দুর্বল, অবলা তো ভাবা হতোই, কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়াকেও অসম্মানের মনে করা হতো। ঘরের মধ্যে নতুন অতিথি এসে যদি আমার অসম্মান বয়ে আনে, তাহলে সেই অতিথিকে তো জীবিত থাকতে দেওয়া যায় না, এটিই ছিল ঐ যুগের নরপিশাচদের সাইকোলজি।
যদিও আজকের দিনেও এমন নরপিশাচের অভাব নেই। সন্তান গর্ভে আসার পরই আলট্রাসনোগ্রাফি করে যদি দেখা যায় যে, কন্যা সন্তান! তাহলেই তো মুখে কুলুপ এঁটে যায়। অনেকেই আলট্রাতে কন্যা সন্তান বুঝতে পেরে সন্তানকে গর্ভপাত করানোর মত কাজও করে থাকে। তখনকার দিনে আলট্রাসনোগ্রাফি ছিল না বলে আগে থেকে জানা যেতো না বলে সন্তান জন্ম নেওয়ার পর দেখত কন্যা সন্তান কিনা, কন্যা সন্তান হলে তাকে জীবিত কবর দিতো। আর আজকের দিনে আলট্রাসনোগ্রাফি করে যখন আগে থেকেই জানা যাচ্ছে যে, অনাগত সন্তান কন্যা শিশু, তখনি তাকে হয় গর্ভপাত করা হচ্ছে, নয়ত দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাচ্ছে।
আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় হচ্ছে, অনার কিলিং। আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, যাকে আজকের দিনে অনার কিলিং এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে যখন একজন মহিলা বা মেয়েকে খুন করা হচ্ছে, তখন তাকে অনার কিলিং বলা হয়। অনার কিলিং প্রায়শই সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এবং সাধারণত পরিবারের ঘনিষ্ঠদের দ্বারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে।
২০০০ সালে জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী প্রতি বছর ৫,০০০ অনার কিলিং হয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার কিছু অংশে অনার কিলিং এর পরিমাণ বেশি হলেও আমাদের দেশেও একেবারেই কম তা কিন্তু নয়।
অনার কিলিং কেন হয়
সাধারণত যেসব কারণে অনার কিলিং হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে,
- বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারণে একজন মহিলাকে তার স্বামী বা পরিবারের সদস্যরা হত্যা করে। এমনকি শুধুমাত্র সন্দেহের বশেও এমনটা হতে পারে।
- পারিবারিক ভাবে একটি সাজানো বিয়ে (arrange marriage) প্রত্যাখ্যান করা।
- নিজ সম্প্রদায়ের বাইরের বা ভিন্ন ধর্মের কাউকে বিয়ে করার জন্যও একটি মেয়েকে তার পরিবারের দ্বারা হত্যা করা হয়ে থাকে।
- অনুপযুক্ত বা অশালীন বলে মনে করা হয় এমন পোশাক পরা বা চালচলনের জন্য একজন মহিলাকে তার পরিবারের দ্বারা হত্যা করা হয়ে থাকে।
• বিবাহবিচ্ছেদ চাওয়া বা আপত্তিজনক সম্পর্ক ত্যাগ করার জন্য একজন মহিলা বা মেয়েকে তার পরিবারের দ্বারা হত্যা করা হয়।বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পর্কিত বা ধর্মীয় আচার আচরণের বাহিরে অশালীন কিছুর জন্যই অনার কিলিং ঘটে থাকে। ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক গোঁড়ামির কারণেই বেশির ভাগ অনার কিলিং ঘটতে দেখা যায়।
কিভাবে অনার কিলিং হচ্ছে?
কিছু বাস্তব জীবনের উদাহরণ দিলে হয়ত বিষয়টি পরিষ্কার বুঝা যাবে যে কিভাবে অনার কিলিং করা হয়ে থাকে।
- ২০১২ সালে, ফারজানা পারভীন নামে একজন পাকিস্তানি মহিলাকে তার পরিবারের সদস্যরা তার পছন্দের পুরুষকে বিয়ে করার জন্য জনসমক্ষে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। ভাবা যায়, শুধু পছন্দ করে বিয়ে করার জন্য খুন হতে হল, তাও আবার নিজ পরিবারের হাতে।
- ২০১৬ সালে, কান্দিল বালোচ নামে একজন ২০ বছর বয়সী মহিলা পাকিস্তানে তার ভাইয়ের দ্বারা সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্কিত ভিডিও পোস্ট করার জন্য খুন হয়েছিল, যা তার পরিবারের দ্বারা অসম্মানজনক হিসাবে দেখা হয়েছিল। কি বলবো?
- ২০০৯ সালে, র্যান্ড আবদেল-কাদের নামে ১৭ বছর বয়সী এক ইরাকি মেয়েকে তার বাবা একজন ব্রিটিশ সৈন্যের প্রেমে পড়ার জন্য হত্যা করেছিল। এখানে ধর্ম বা সংস্কৃতির চেয়ে রাষ্ট্রীয় আবেগটি কাজ করেছে বেশি।
- ২০০৭ সালে, হাতুন সুরুকু নামে একজন তুর্কি মহিলাকে জার্মানিতে তার ভাই গুলি করে হত্যা করেছিল, কারণ সে অনেকটা পশ্চিমাদের মত চলাফেরা করতো এবং পরিবারের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধগুলি অনুসরণ করছিল না।
অনার কিলিং এর পিছনের মূল কারণ
আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগ বা তারও আগে থেকে এখন পর্যন্ত অনার কিলিং মিশন যেভাবে চলে আসছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে এর পিছনে বহুমুখী উদ্দেশ্য এবং ক্রিয়া রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গুলো নিম্নরূপ:
- কিছু সমাজে, নারীর প্রতি ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক মনোভাব এবং লিঙ্গ ভূমিকা অনার কিলিং এর পিছনের কারণ হিসেবে অবদান রাখতে পারে। মহিলা এবং মেয়েদের প্রায়ই পরিবারের সম্মানের বাহক হিসাবে দেখা হয় এবং তাদের আচার আচরণ কঠোর আচরণবিধি মেনে চলাটাই স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হয়। এই নিয়মগুলো থেকে যখনি কারো দ্বারা ভঙ্গ করা হয় এবং যার ফলশ্রুতিতে পরিবারের খ্যাতির পাশাপাশি সম্মানের জন্য হুমকিরূপে দেখা দেয়, তখনি তা সহিংসতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
- পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রায়ই অনার কিলিং করা হয়, যেখানে পুরুষরা নারী ও মেয়েদের উপর অতিমাত্রায় ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ রাখে। মহিলা এবং মেয়েদের প্রায়ই পুরুষদের সম্পত্তি হিসাবে দেখা হয় এবং পুরুষ পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো যতই নারীবান্ধব না হোক না কেন, তা মেনে চলার আশা করা হয়।
- কিছু ক্ষেত্রে, ধর্মীয় গোঁড়ামি অনার কিলিংয়ে ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু চরমপন্থি এই অনুশীলনকে সমর্থন করার জন্য ধর্মীয় রীতিনীতি ব্যবহার করে, দাবি করে যে পরিবারের জন্য লজ্জা বয়ে এনেছে এমন একজন পরিবারের সদস্যকে হত্যা করা একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা; যা হয়ত আদতে ভিত্তিহীন।
- যেসব নারী ও মেয়েরা দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে এবং শিক্ষার সুযোগ সীমিত তাদের প্রায়ই অনার কিলিং এর শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। দরিদ্রতা তো সব যুগেই অভিশাপের ন্যায় কাজ করে আর শিক্ষার অভাব আজকের দিনে অচল নোটের ন্যায়। তাই, দারিদ্র এবং একসাথে অশিক্ষিত, তার উপর যেকোনো অন্যায়ই চাপিয়ে দেওয়া সহজতর।
- কিছু দেশে, সরকার বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী অনার কিলিংয়ের সাথে জড়িয়ে পড়তে পারে; প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনুশীলনের সহনশীলতার মাধ্যমে। কেননা, যারা অনার কিলিং করছে, তাদেরকে লঘু শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, যা কিনা অন্যদেরকে অপরাধ করতে আরও বেশি উৎসাহী করে তুলে। অন্যদিকে যারা অনার কিলিং এর ভিকটিম, তাদের কৃত অপরাধ (অনার কিলারদের চোখে)’কে গুরুতর অপরাধ হিসেবে সমাজে প্রচার করা হয়, যার ফলে ভিকটিম রীতিমত অপরাধীতেই পরিণত হয়। তার উপর মিডিয়া ট্রায়াল তো আছেই।
সম্মানের কথা চিন্তা করে আমরা যেভাবে নারীদেরকে আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগের ন্যায় খুন করছি, আমরা পুরুষরা যখন ঘুষ খাচ্ছি, দুর্নীতি করছি, এতীম-গরীবের হক মেরে দিচ্ছি, তখন ঐ সম্মানের আঁচলে টান পড়ে না?
সংস্কৃতি বা ধর্মের দোহাই দিয়ে যদি এলোপাথাড়ি খুনকে জায়েজ বা বৈধ মনে করা হয়, তাহলে একসময় পৃথিবীতে আর মানব সভ্যতা টিকে থাকবে না ধর্ম বা তথাকথিত সংস্কৃতি পালন করার জন্য।
পরবর্তী পর্বে অনার কিলিং থেকে রক্ষা এবং প্রতিহত করার বিষয়ে লেখার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ্।

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )