মাঝরাতে ফাঁকা রাস্তায় হেলমেট ছাড়া বেপরোয়া গতিতে দুই যুবক একটি মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিল। এমন সময় রাস্তায় থাকা ট্রাফিক পুলিশ তাদেরকে সিগন্যাল দিয়ে থামায়। নেহাতই বাধ্য হয়ে দুই যুবক ট্রাফিক পুলিশের একটু সামনে গিয়ে থামলো।
পুলিশ তখন যুবকদের জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের হেলমেট কোথায়? তাছাড়া আপনারা বেপরোয়া ভাবে এতো দ্রুত গতিতে কোথায় যাচ্ছেন? আপনাদের গাড়ির কাগজপত্র এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করুন।
এমন সময় দুই যুবকের এক যুবক বলে উঠল, আপনি আমাকে চেনেন?
ট্র্যাফিক পুলিশ প্রতি উত্তরে বললেন, প্রতিনিয়ত অজস্র গাড়ি আসছে আর যাচ্ছে, ট্রাফিক আইন বাস্তবায়ন করতে কাউকে যেমন আমার চেনার দরকার নেই, আপনাকেও তেমনি আমার চেনার দরকার নেই। আমার বরং জানা দরকার আপনার মোটরবাইকের কাগজপত্র আছে কি না এবং আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি না। আপনারা ইতিমধ্যে হেলমেট না পরে ট্র্যাফিক আইন ভঙ্গ করেছেন। তার উপর অতিরিক্ত স্পিডে যাচ্ছেন। দয়া করে আমাকে আমার কাজে সহায়তা করুন; গাড়ির কাগজপত্র এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করুন।
পুলিশের প্রশ্নে সামান্য বিচলিত না হয়ে দুই যুবক মোটরবাইক থেকে নেমে পুলিশের কাছে গিয়ে বলল, আপনি আমাকে চেনেন? আমি হচ্ছি এমপির ভাগিনা, অমুক এমপি আমার মামা। আমি এক ফোন কল করলেই, আপনার চাকরি চলে যাবে।
এমন সময় ট্রাফিক পুলিশ তার সাথে থাকা আরেকজন পুলিশকে ইশারা দিয়ে বলল, কালকে এখানে যে একজন ন্যাংটা পাগল নাচানাচি করছিল আর পরিচয় দিচ্ছিল যে সে এমপির ভাগিনা, এমপি তার মামা, খেয়াল আছে? তারপর যুবকদের দিকে তাকিয়ে ট্রাফিক পুলিশ বললেন, ঐ ন্যাংটা পাগলটা আপনার মত একই পরিচয় দিয়েছিল যে, তার মামা এমপি, সে এমপির ভাগিনা, তার এক কলে আমার চাকরি চলে যাবে। ওই ন্যাংটো পাগলা কি আপনার ভাই নাকি?
তারপর, দুই যুবক খেই হারিয়ে ফেললো।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন পরিচয় দিয়ে প্রভাব দেখিয়ে বাড়তি সুবিধা পেতে চাই বা সহজ করে বললে আমরা নিজেরা আইন থেকে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার নামে আইন ভঙ্গ করে থাকি। পৃথিবীর সব দেশেই আইন সবার জন্য সমান; ক্ষেত্র বিশেষে আইনের প্রয়োগ হয়ত কারো জন্য বেশি, কারো জন্য কম। যেমন, আপনি একজন সাধারণ মানুষকে একটি থাপ্পড় দিলে সেটা শুধু থাপ্পড় হিসেবে গণ্য হবে; কিন্তু আপনি যখন একজন মন্ত্রীকে থাপ্পড় দিবেন, তখন মাথায় রাখতে হবে মন্ত্রী শুধুমাত্র একজন মানুষ নন, তিনি একটি দেশের পতাকা বহন করেন, তাই মন্ত্রীকে থাপ্পড় দেওয়া আর সাধারণ একজন মানুষকে থাপ্পড় দেওয়ার প্রভাব এক হবে না।
তাই, আইন সবার জন্য সমান হলেও আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান নয়। একইভাবে আমাদের প্রত্যেকের প্রভাবও একই না বলে যার প্রভাব বেশি তার প্রভাব ব্যবহার করতে আমরা ছলনা করছি। আমরা আইন থেকে বা আইন ভেঙে বাড়তি সুবিধা নিতে নিজেদের পরিচয় গোপন করে এমন কারো পরিচয় প্রদান করি, যেটা দিয়ে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
যেমন ধরুন, একজন ব্যক্তি যদি কারো সামনে নিজেকে একটি মিথ্যে পরিচয় দেয় সেক্ষেত্রে তার এই ছদ্মবেশের মাধ্যমে সে যে প্রতারণা করলো, এটি আমাদের দণ্ডবিধি অনুযায়ী অপরাধ। একইভাবে, আমরা অনেক সময় দেখে থাকি, পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভুয়া পরিচয় দিয়ে অর্থাৎ সে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নয় কিন্তু সে ওই ধরনেরই পোশাক পড়ে মানুষের সাথে প্রতারণা করছে, চাঁদাবাজি করছে কিংবা অনেক সময় তুলে নিয়ে যাচ্ছে, এই যে সে অন্যের রূপ ধারণ করলো, সেটাই আমাদের দণ্ডবিধি অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ। আজকে আমরা এই ছদ্মবেশে যে প্রতারণা করা হয়, সে সম্বন্ধে সামান্য একটু আলোচনা করব।
দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৪১৬ ধারা অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি যদি নিজেকে অন্য ব্যক্তি বলে প্রতারণা করে অথবা জ্ঞাতসারে কোন ব্যক্তিকে অন্য ব্যক্তি বলে চালিয়ে প্রতারণা করে অথবা নিজেকে বা অন্য কোন ব্যক্তিকে সে নিজে বা সে ব্যক্তি অন্য যে ব্যক্তি নয় সে ব্যক্তি বলে চালিয়ে প্রতারণা করে, তবে উক্ত ব্যক্তি অপরের রূপ ধারণ করে প্রতারণা করেছে বলে গণ্য হবে।
আমাদের দেশে এক সময় সাব রেজিস্ট্রি অফিসে, একজনের জায়গায় আরেকজনকে দেখিয়ে প্রচুর জায়গা জমি একজনের নাম থেকে আরেকজনের নামে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিজের মা বোনের সম্পত্তি নিজে আত্মসাৎ করার জন্য নিজের স্ত্রী বা অন্য কোন মহিলাকে নিজের মা বোনের পরিচয় দিয়ে বোন থেকে সম্পত্তি লিখে নিয়ে গেছে। ভাই প্রবাসে থাকলে বা মারা গেলে সেক্ষেত্রে অন্য কাউকে ভাইয়ের পরিচয় দিয়ে তার সম্পত্তি লিখে নেওয়ার মত ঘটনাও ঘটেছে একসময় অহরহ।
তাছাড়া, অতীতে বিদেশ থেকে এসে বা অনেক দিন পরে এসে চেহারার পরিবর্তনের কারণে অনেকেই বিভিন্ন প্রতারণা করতো। কেউ কেউ স্বামী স্ত্রী সেজেও প্রতারণা করতো, করতো সন্তান সেজে।
তবে, আজকের দিনে এই ধারার সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ হচ্ছে, মোবাইলে ফোন করে বিভিন্ন মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বা ছদ্মবেশে। আমরা প্রায় সময় দেখে থাকি, মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, নগদ, রকেটের অফিস থেকে কল করা হয়েছে বলে বিভিন্ন প্রতারক প্রতারণা করা হয়ে থাকে, মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়ে থাকে।
৪১৬ ধারার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তির রূপ ধারণ করা হয়েছে সে ব্যক্তি প্রকৃত ব্যক্তি হোক বা কাল্পনিক ব্যক্তি হোক না কেন, সে অপরাধটি অনুষ্ঠিত করেছে বলে গণ্য হবে। এখন সবসময় যে পুলিশ বা অন্য কোন বাস্তব ব্যক্তির রূপ ধারণ করলে অপরাধ হবে তা নয়, যদি কেউ কোন কাল্পনিক ছদ্মবেশ ধরে সেটিও অপরাধ হবে। উদাহরণস্বরূপ, জিনের বাদশাহ নামে মাঝে মাঝে কেউ ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকে, সেটিও এই ধারার আওতায় পড়বে, যদিও সেটি কাল্পনিক চরিত্র।
দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর এর ৪১৯ ধারায়, অপরের রূপধারণ করে প্রতারণার শাস্তির সম্বন্ধে বলা হয়েছে বলা হয়েছে। অপরের রূপ ধারণ করে যদি কেউ প্রতারণা করে সেক্ষেত্রে সে যে কোন বর্ণনার তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে বা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )