রামিম তার বন্ধু তারেককে নিয়ে চুরির উদ্দেশ্যে এক প্রবাসীর বাড়িতে ঢুঁকে। বাড়িতে সেদিন বিশেষ কেউ ছিল না, প্রবাসীর স্ত্রী এবং ৬ বছরের শিশু। যথা সম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করে নিঃশব্দে চুরির চেষ্টার এক পর্যায়ে হঠাৎ প্রবাসীর স্ত্রী টের পেয়ে জেগে যায়।
বাড়িতে পুরুষ সদস্য কেউ নেই জেনেও নিজ সাহসিকতায় চোরদেরকে ধরার উদ্দেশ্যে প্রবাসীর স্ত্রী যখন চিৎকার দেয়, তখন রামিম তারেক নিরুপায় হয় আগে প্রবাসীর স্ত্রীর মুখ চেপে ধরে তারপর যথা সম্ভব হাত পা বেঁধে প্রাণের ভয় দেখায়।
ভয় পেয়ে প্রবাসীর স্ত্রীর শুভবুদ্ধির উদয় হয় আর সে বুঝতে পারে দুই চোর সদস্যের সাথে তার একার পক্ষে লড়াই করা সম্ভব না। তাই, চোর যা নিতে পারে নিয়ে যাক, তাকে অন্তত প্রাণে ছেড়ে দিক। যেই চিন্তা সেই কাজ; চুপসে গেছে প্রবাসীর স্ত্রী আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল চোররা কি কি নিচ্ছিল।
সজাগ হওয়ার আগে যা চুপিসারে চুরি করেছিল এখন বরং আলমারির তালা খুলে যা যা সম্ভব হচ্ছিল, সবই খুলে নিচ্ছে। রামিম এবং তারেক তাদের চেহারা ডেকে রাখলেও তাদের মধ্যকার কথোপকথনের কারণে প্রবাসীর স্ত্রী তাদেরকে চিনতে পেরে যায়। চুরি বেশির ভাগ সময়, জানাশোনা লোকদের মধ্যেই হয়ে থাকে বলে প্রচলিত আছে। চোররা প্রবাসীর স্ত্রীর আশেপাশের লোকজন এবং পরিচিত বলেই এক পর্যায়ে সে বলে উঠে, এই তোরা রামিম আর তারেক না?
চোরদের মাথায় যেন বাজ পড়লো, মুহূর্তেই তাদের মেরুদণ্ডের উপর দিয়ে একটা হিম হওয়া বয়ে গেলো। রীতিমত চুপসে গেলো তারা দুইজন। রামিম তো একেবারে ভেঙ্গে পড়ে প্রবাসীর স্ত্রীর পায়ে পড়ে মাফ চাওয়ার জন্য একরকম এগিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনি তারেকের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায়।
তারেক তৎক্ষণাৎ মোবাইল ক্যামেরায় ভিডিও অন করে প্রবাসীর স্ত্রীর কাছে যায় এবং তার মুখ চেপে ধরে জোর পূর্বক ধর্ষণ করে। ধর্ষণ কর্ম শেষে তারেক প্রবাসীর স্ত্রীকে ভিডিও দেখিয়ে হুমকি দেয় যে, তুই যদি আমাদের নাম বাহিরে প্রকাশ করিস তাহলে এই ভিডিও সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। ছদ্মনামে ঘটনাটি মোটামুটি এতটুকুই।
এরপর অনেক পানি ঘোলা হয় এবং একসময় এক কান দুই কান করে, থানা পুলিশ গড়িয়ে আদালতে মামলাটি আসে। মামলায় রামিম আর তারেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দণ্ডবিধির ৩৮৪ ধারা অনুযায়ী বলপূর্বক গ্রহণ, ৩৮৭ ধারা অনুযায়ী বলপূর্বক গ্রহণের জন্য মৃত্যু বা গুরুতর আঘাতের ভয়ে রাখা, ৩০৭ ধারা অনুযায়ী হত্যার চেষ্টা, ৩৭৬ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণ সহ যাবতীয় কিছু ধারা।
এখন কথা হচ্ছে, একই মামলায় রামিম এবং তারেকের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন অপরাধের যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে যদি সবগুলো বা একের অধিক প্রমাণিত হয়, তবে সে ব্যক্তির সাজা কিভাবে প্রদান করতে হবে?
ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ ধারা অনুযায়ী, একই মামলায় যদি কোন অপরাধী ভিন্ন ভিন্ন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়, তাহলে সে ব্যক্তি দণ্ডবিধির ৭১ ধারা অনুযায়ী, এখতিয়ার সম্পন্ন আদালত ঐ অপরাধীর কৃত প্রত্যেক অপরাধের জন্য পৃথক পৃথক শাস্তি প্রদান করতে পারবেন।
এখন কোন অপরাধীর কৃত ২ টি অপরাধের জন্য আদালত যদি ভিন্ন ভিন্ন দণ্ড প্রদান করেন, তাহলে উক্ত ২ টি দণ্ড কিভাবে কার্যকর হবে?
যদি উপরে উল্লেখিত অপরাধের দায়ে রামিমকে আদালত বলপূর্বক গ্রহণের দায়ে ৫ বছর আর এবং হত্যার চেষ্টার দায়ে ৭ বছর সাজা প্রদান করে, তাহলে দুইটি সাজা একসাথেও চলতে পারে আবার একটি শেষ হলে অন্যটি শুরু হতে পারে।
তবে, এক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হচ্ছে, দুইটি অপরাধের জন্য পৃথক পৃথক সাজা প্রদান করা হলে একটি শেষ হলে অন্যটি শুরু হবে। একে কারাবাসের সমন্বয় বা Consisting of Imprisonment বলা হয়ে থাকে। তবে, আদালত যদি নির্দেশ প্রদান করে যে পৃথক পৃথক দণ্ড একই সাথে চলবে তাহলে উভয় দণ্ড একই সাথে চলতে পারে। অন্যথায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী, একটি দণ্ড শেষ হলে অন্যটি শুরু হবে।
এখন নতুন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, রামিম বা তারেক যদি একই মামলায় দুই বা ততোধিক দণ্ডে দণ্ডিত হয়, তাহলে তারা আপীল করার বেলায় কোন দণ্ডের বিরুদ্ধে আপীল করবে?
ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ (৩) ধারা অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি একই মামলায় দুই বা ততোধিক দণ্ডে দণ্ডিত হলে, তখন আপীল করার সময় উক্ত একাধিক দণ্ডগুলোকে একটি দণ্ড হিসেবে গণ্য করতে হবে।
আবার, একই মামলায় ভিন্ন ভিন্ন দণ্ডের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। একই মামলায় একাধিক অপরাধের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দণ্ড দিতে গিয়ে সেটি আবার অনেক বেশি দণ্ড হয়ে যেতে পারে বলে সেখানে কিছু সীমাবদ্ধতা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
প্রথম সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ (২) (ক) ধারা অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি একই মামলায় দুই বা ততোধিক দণ্ডে দণ্ডিত হলে, তাকে পরপর কারাদণ্ডের ক্ষেত্রে ১৪ বছরের বেশি মেয়াদের কারাদণ্ড প্রদান করা যাবে না। অর্থাৎ, এক অপরাধের জন্য ৫ বছর আরেক অপরাধের জন্য ৭ বছর এভাবে ভিন্ন ভিন্ন অপরাধের জন্য যত সুখী তত সাজা দেওয়া গেলেও সেটি কোন ভাবেই ১৪ বছরের বেশি হবে না।
দ্বিতীয় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ (২) (খ) ধারা অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি একই মামলায় দুই বা ততোধিক দণ্ডে দণ্ডিত হলে, ম্যাজিস্ট্রেট তার স্বীয় এখতিয়ারের দ্বিগুণের বেশি সাজা প্রদান করবেন না। নিম্নে ছক আকারে দেখানো হল কোন ম্যাজিস্ট্রেট কত সাজা প্রদান করতে পারেনঃ
স্বাভাবিক ভাবে যে ম্যাজিস্ট্রেট যে সাজা প্রদান করতে পারেন | ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ (২) (খ) ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ সাজা |
চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, সাথে অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এবং চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সাথে অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট যে কোন বর্ণনার ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড প্রদান করতে পারবেন। | সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড। |
মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এবং প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট যে কোন বর্ণনার ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড প্রদান করতে পারবেন। | সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড। |
দ্বিতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট যে কোন বর্ণনার ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড প্রদান করতে পারবেন। | সর্বোচ্চ ৬ বছরের কারাদণ্ড। |
তৃতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট যে কোন বর্ণনার ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড প্রদান করতে পারবেন। | সর্বোচ্চ ৪ বছরের কারাদণ্ড। |
আশা করি, একই মামলায় ভিন্ন ভিন্ন অপরাধের বিষয়টি কি, কিভাবে বিচার এবং সাজা প্রদান করা হয়, সে বিষয়টি আমরা বুঝতে সক্ষম হয়েছি। ধন্যবাদ।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )