দৈনন্দিন কাজে, চলাফেরার পথে, পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে আমরা সকলেই কম বেশি চেক জালিয়াতি (Forgery)-র সাথে পরিচিত। পরিচিত, জমি জমার দলিলের ক্ষেত্রে জাল দলিল সম্বন্ধে। জাল কবলা, জাল দলিল, চেক জালিয়াতি (Forgery), স্বাক্ষর নকল এর প্রায় সবকিছুই জালিয়াতি হিসেবে আমরা গণ্য করে থাকি। এই যে জালিয়াতির যে পুরো প্রসেস সেটা প্রকৃতপক্ষে কি, কেন, কিভাবে আজকে আমরা সেই বিষয়ে আলোচনা করব।
লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও’র ‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’ (Catch Me If You Can) সিনেমাতে দেখানো হয়েছিল যে, লিওনার্দো কতটা শৈল্পিক ভাবে চেক জালিয়াতি (Forgery) করে থাকেন। তার চেক জালিয়াতির কর্মকাণ্ড স্বয়ং ব্যাংকের কর্মকর্তারাও ধরতে পারত না। একমাত্র এফবিআই যখন সেটিকে শনাক্ত করতে পারে তখন তারা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও’র পিছু নেয় এবং দিন শেষে দেখা যায় যে, তারা ওই লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও’কেই ভবিষ্যতে অন্য কেউ যাতে জালিয়াতি করতে না পারে বা চেক জালিয়াতি করলে সেই চেক জালিয়াতি শনাক্ত করার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। অনেকের কাছে এই জালিয়াতি এক ধরনের শিল্প পর্যায়ে পড়ে। একটি আসল জিনিসকে দেখে হুবহু নকল তৈরি করা, যতটা সহজ মনে করা হয় ততটা সহজ কিন্তু নয়। যার তার পক্ষে সেই কাজ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু যার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চলে যাচ্ছে অবৈধভাবে, তাঁর কাছে কিন্তু জালিয়াতিটা কখনও শিল্পর পর্যায়ে পড়ে না, যে পর্যায়ে পড়ে তা হচ্ছে চুরি। তবে, এই চুরি সাধারণ চুরি নয়, এটি করা হয় বুদ্ধি খাটিয়ে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মিথ্যা ডকুমেন্টস তৈরির মাধ্যমে। ঠিক তেমনি যার একটি সম্পত্তি জাল দলিলের কারণে তার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে সেটি সে কখনোই শিল্পের পর্যায়ে না ভেবে, ভাববে জাস্ট প্রতারণা। যার ফলে ব্রিটিশ আমলে দণ্ডবিধি ১৮৬০ এ জালিয়াতিকে একটি শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।
দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৪৬৩ ধারায় জালিয়াতিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। মোটামুটি পাঁচ ধরনের কাজকে জালিয়াতি হিসেবে আইনানুগভাবে আমরা ধরতে পারে।
প্রথমত, কোনও ব্যক্তি বা জনসাধারণের ক্ষতিসাধন করতে; আপনার স্বাক্ষর নকল করে আপনার চেক বই দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ফেললে, সেটি আপনার ক্ষতিসাধন হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, কোনও দাবি বা অধিকার সমর্থন করতে; একটি ষ্ট্যাম্পে আপনার কাছ থেকে কোন দাবি আদায় পূর্বক ইচ্ছে মত কিছু লিখে সেখানে আপনার নাম, ঠিকানা ব্যবহার করে আপনার অঙ্গিকার নামাস্বরূপ আপনার স্বাক্ষর নকল করলে, যে সম্বন্ধে আপনি অবগত নন এবং যা আপনার স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়।
তৃতীয়ত, কোনও ব্যক্তিকে কোন সম্পত্তি পরিত্যাগ করতে; জাল দলিল এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। জাল দলিল প্রস্তুতের মাধ্যমে আপনার সম্পত্তির মালিকানা আপনার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া।
চতুর্থত, কোন লোককে প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্যে চুক্তি সম্পাদনে বাধ্য করতে; মিথ্যা কোন চুক্তি আপনার নামে করে আপনার হয়ে তৈরি করা হলে এবং সেটি আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হলে। যেমন, মিথ্যা বায়না দলিল করে আপনাকে আপনার জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হল বা আপনি টাকা ধার নিয়েছেন, এমন ডকুমেন্ট তৈরি করে আপনাকে অন্যায়ভাবে টাকা ফেরত দিতে বাধ্য করা।
পঞ্চমত, প্রতারণা করার অভিপ্রায় বা প্রতারণা সংঘটিত হতে পারে; যেকোনো ধরনের প্রতারণা করার উদ্দেশ্যে যে কোনো ধরনের ডকুমেন্টস তৈরি করা।
উপরের যেকোনো একটি উদ্দেশ্যে কোন মিথ্যা দলিল বা দলিলের অংশ প্রস্তুত করাকে জালিয়াতি (Forgery) বলা হয়।
এখানে জালিয়াতি (Forgery) সংগঠনের ক্ষেত্রে কোন দলিল বা দলিলের কোন একটি অংশ ইচ্ছে কৃত ভাবে মিথ্যা দলিল প্রস্তুত করতে হবে (Making a False Document) এবং যার ফলে স্পেসিফিক কারো ক্ষতি হচ্ছে বা কোন একটি অবৈধ অধিকার তৈরি হচ্ছে বা বৈধ অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, কোন একটি চুক্তি অবৈধভাবে করা হচ্ছে বা কোন একটি বৈধ চুক্তিকে অবৈধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে ইত্যাদি যে কোন ভাবে যে কোনো উদ্দেশ্যে কোনো সম্পূর্ণ বা আংশিক মিথ্যা দলিল প্রস্তুত করলে তাকে জালিয়াতি (Forgery) বলা হবে।
জালিয়াতি (Forgery)’র শাস্তি কি?
সকল চোর যেমন একই স্টাইলে চুরি করে না, তেমনি সকল জালিয়াতিও একই প্রকৃতির হয় না। যার ফলে জালিয়াতির শাস্তিও ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের।
● জালিয়াতির শাস্তি হচ্ছে দুই বছর পর্যন্ত যে কোনও বর্ণনা কারাবাস বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। একই ভাবে, জাল দলিল জেনেও আসল হিসেবে ব্যবহার করা হলে তার শাস্তি হচ্ছে যে কোনও বর্ণনার দুই বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। অর্থাৎ, জালিয়াতি করলে যেমন শাস্তি, জালিয়াতি না করেও জাল দলিল জেনেও সেটিকে আসল বলে চালিয়ে দেওয়া বা ব্যবহার করা হলেও একই শাস্তি উপভোগ করতে হবে।
● কিন্তু, জালিয়াতি যদি করা হয় আদালতের নথিপত্র বা সরকারের রেজিস্টার প্রভৃতিতে, সেই ক্ষেত্রে সেটি হচ্ছে সাত বছর পর্যন্ত যে কোনও বর্ণনার কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড। উদাহরণস্বরূপ, অনেক সময় দেখা যায়, আদালতের সীলমোহর নকল করে জালিয়াতি করা হয়।
● তাছাড়া, মূল্যবান জামানত, উইল প্রভৃতি জাল করণ করা হলে সেই ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাবাস বা ১০ বৎসর পর্যন্ত যে কোন বর্ণনার কারাবাস এবং অর্থদণ্ড।
● প্রতারণার প্রয়োজনে জালিয়াতি করা হলে সেই ক্ষেত্রে যে কোন বর্ণনার কারাদণ্ডে যার মেয়াদ সাত বছর পর্যন্ত হতে পারে৷ এবং অর্থদণ্ড।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )