ধারা ৪৯৬: জামিন – অধিকার না অনুগ্রহ? 

ফৌজদারি আইন

ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের একটি কোর্টরুমে একটি জামিনের শুনানি চলছে। আসামি একজন তরুণ, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ মারপিটের যা কিনা একটি জামিনযোগ্য অপরাধ; দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ১৬০ ধারা অনুসারে। 

আসামী পক্ষের আইনজীবী জামিন দরখাস্ত দিয়ে মৌখিক ভাবে জামিন চাইলেন। তখনি আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (এপিপি) লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেনঃ
“ইউর অনার, যদিও অপরাধটি জামিনযোগ্য, তবে আমরা মনে করি পরিস্থিতি বিবেচনায় এখনই তাকে জামিনে মুক্তি দিলে তদন্তে প্রভাব পড়তে পারে। সাক্ষীদের ভয় দেখানোর সম্ভাবনা আছে। এমনকি অভিযুক্ত পলাতক হয়ে যেতে পারেন। তাই জামিন না দেওয়ার অনুরোধ করছি।”

আদালতে মুহূর্তেই গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো। আসামিপক্ষের আইনজীবী এপিপি’র তোলা প্রতিটি কথাই যথারীতি অস্বীকার করলেন। 

কিন্তু, এপিপি সাহেব মানতে নারাজ। তিনি বললেনঃ

“ইউর অনার, জামিন দিলেই আসামী বের হয়ে বাদীকে হুমকি দিবে এবং বলবে কি করতে পেরেছেন, দেখ আমি ঠিক ঠিক বের হয়ে এসেছি। কারো ক্ষমতা নেই আমাকে আটকে রাখার। কোর্টকাছারি আমার পকেটে।”

তখন আসামীর আইনজীবী তার ফাইল খুলে একগুচ্ছ রেফারেন্স আদালতের সামনে তুলে ধরেন। কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস নিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেনঃ

“মাই লর্ড, ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৪৯৬ বলছে, জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিন দেওয়া আদালতের আইনি বাধ্যবাধকতা। এটি অনুগ্রহ নয়, এটি তার অধিকার। আমি ১৯৩২ সালের একটি মামলার রেফারেন্স তুলে ধরছি—AIR 1932 All 327 এই মামলায় আদালত স্পষ্টভাবে বলেছে, ‘জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন দেওয়া আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক।’

আরেকটি রেফারেন্স দেখুন, 5 DLR (FC) 154 মামলায় বলা হয়েছে, ‘জামিন মানে হলো একজন ব্যক্তি পুলিশ হেফাজত থেকে জামিনদারের জিম্মায় যাওয়া। ওই জামিনদার তার উপস্থিতি নিশ্চিত করবেন, এর বাইরে কিছু নয়’ এবং সর্বশেষে বলি, 15 DLR 429 (SC)–এ বলা আছে, ‘সন্তোষজনক জামিনদার থাকলে অভিযুক্তের জামিন পাওয়ার অধিকার অপরাজেয়। তিনি কোর্টে আওতাধীন এলাকা থেকে পালিয়ে যাবেন কিনা, সেটা কল্পনার ভিত্তিতে বলা যায় না।’-এই কারণে, আমার আবেদন, আসামিকে আইন অনুযায়ী জামিন দেওয়া হোক।”

এপিপি আবার উঠে দাঁড়ান এবং বললেনঃ
“কিন্তু আমার প্রতিপক্ষ আইনজীবী যে রেফারেন্স দিচ্ছেন, তারা পরিস্থিতি বিবেচনায় কথা বলেননি। এখানে একটা ঝুঁকি আছে। আমরা চাই না তদন্ত বাধাগ্রস্ত হোক।”

আসামিপক্ষের আইনজীবী তখন আদালতে আরও যুক্তি তুলে ধরেন যে, “ইউর অনার, অভিযুক্ত স্থানীয় একজন তরুণ ছাত্র, কোনো পূর্ব অপরাধ রেকর্ড নেই, পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই এবং সে জামিন পেলে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবে। তাছাড়া, একজন মানুষ যদি জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত হন, অথচ তিনি জামিন না পান, তাহলে আইনের উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়। এভাবে তো যেকোনো সাধারণ মানুষকেও পুলিশ হেফাজতে আটকে রাখা সম্ভব। এটা তো আইন নয়, হয়রানি।”

প্রায় আধা ঘণ্টার শুনানি শেষে ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ দিলেনঃ
“আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ জামিনযোগ্য অপরাধের আওতায় পড়ে। ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৪৯৬–এর প্রেক্ষিতে, জামিন তার অধিকার। রাষ্ট্রপক্ষ শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, কিন্তু কেবল শঙ্কার ভিত্তিতে জামিন প্রত্যাখ্যান করা যায় না। অতএব, আদালত জামিন মঞ্জুর করছেন। আসামিকে ১,০০০ টাকা মুচলেকায় জামিন দেওয়া হলো, শর্ত সাপেক্ষে তিনি পরবর্তী তারিখে আদালতে হাজির হবেন।”

উপরের ঘটনাটি কাল্পনিক কিন্তু এমন অজস্র ঘটনা দেশের ৬৪ জেলার কোর্টকাছারিতে সপ্তাহের ৫ দিন নিয়মিত ঘটছে। জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন যে অধিকার এটা জানে না অনেকেই, এমনকি আসামী নিজেই জানে না তার অধিকার সম্বন্ধে। এর কারন হচ্ছে, আইন সম্বন্ধে জানতে তাদের অনীহা। আমরা চেষ্টা করছি, মানুষকে সহজ সাবলীল ভাষায় কোর্টরুম ড্রামার মতো করে হলেও আইন জানাতে। তো চলুন আজকে জানার চেষ্টা করি, জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন যে অধিকার সে সম্বন্ধে। 

বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৪৯৬ অনুযায়ী, যদি কেউ জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত হন, তবে তিনি জামিন পাওয়ার অধিকার রাখেন। এটি কোনো দয়া বা অনুগ্রহ নয়, এটি একটি আইনি অধিকার

ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৪৯৬ তে কি বলা আছে? 

ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৪৯৬ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত হন এবং তাকে গ্রেফতার করা হয় তাহলে তিনি যদি জামিন নিতে প্রস্তুত থাকেন, তবে পুলিশ বা আদালত জামিন দিতে বাধ্য থাকার কথা বলা হয়েছে।

এই ধারায় আরও বলা আছে, পুলিশ অফিসার বা বিচারক চাইলে জামিন না নিয়েও (অর্থাৎ কোনো জামিনদার ছাড়া) একটি মুচলেকায় মুক্তি দিতে পারেন—যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রতিশ্রুতি দেন যে, যখনই তাকে আদালতে ডাকা হবে, তখন তিনি উপস্থিত থাকবেন।

তবে ধারা ১০৭ ও ১১৭–এর বিশেষ কিছু উপধারার ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়, যেমন—পুলিশ যখন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয় (যেমন ভবিষ্যতে অপরাধ করার সম্ভাবনায় কাউকে আটক করা হয়)।

জামিনযোগ্য অপরাধ বনাম অজামিনযোগ্য অপরাধ

জামিনযোগ্য অপরাধ বলতে বোঝায় এমন অপরাধ, যেখানে জামিন পাওয়া অধিকার। উদাহরণ: মারপিট, অপরাধজনক ভীতিপ্রদর্শন ইত্যাদি।

অজামিনযোগ্য অপরাধ হলো: খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি গুরুতর অপরাধ। এসব ক্ষেত্রে জামিন পাওয়া কোনো অধিকার নয়, বরং আদালতের বিবেচনার বিষয়।

আদালতের দায়িত্ব কী?

এই ধারা অনুযায়ী, যখন কেউ জামিনযোগ্য অপরাধে আটক হন এবং জামিন চাইলে আদালত বা পুলিশ অপ্রয়োজনীয় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। অর্থাৎ আদালতের এখতিয়ার থাকলেও, আইন অনুযায়ী তাদের বাধ্যতামূলকভাবে জামিন দিতে হবে। এটাকে ইংরেজিতে বলা হয় “mandatory”—অর্থাৎ, আদালতের ইচ্ছার বিষয় নয়, এটি একটি বাধ্যবাধকতা।

গুরুত্বপূর্ণ কেস রেফারেন্স

১. 5 DLR (FC) 154 – এই মামলায় আদালত বলেছে, জামিন মানে হলো একজন ব্যক্তিকে পুলিশ হেফাজত থেকে জামিনদারের জিম্মায় দেওয়া। সেই জামিনদার আদালতকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, অভিযুক্ত যখনই প্রয়োজন হবে তখন আদালতে হাজির হবেন।

২. AIR 1932 All 327 – এখানে বলা হয়েছে, ধারা ৪৯৬ কোনো অনুমোদন নয়, বরং এটি একটি আদেশমূলক ধারা। জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন দেওয়া আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক। এটি অনুগ্রহ বা কৃপা নয়।

৩. 15 DLR 429 (SC) – এই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, যদি সন্তোষজনক জামিনদার পাওয়া যায়, তাহলে অভিযুক্তের জামিন পাওয়ার অধিকার কেউ ঠেকাতে পারে না। এ অধিকার অপরাজেয়

সবশেষে বলতে হয়, ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৪৯৬ আসলে জনগণের আইনি নিরাপত্তার একটি হাতিয়ার। এটি নিশ্চিত করে, একজন ব্যক্তি শুধুমাত্র সন্দেহ বা হালকা অপরাধে জেল খাটবেন না। তবে অনেকেই এই অধিকার সম্পর্কে জানেন না, ফলে পুলিশি হয়রানি বা অপ্রয়োজনীয় জেল খাটার শিকার হন।

সুতরাং, আইন না জানাও একটি সমস্যার অংশ। একজন নাগরিক হিসেবে আপনার উচিত এসব মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং প্রয়োজনে আইনজীবীর সাহায্য নেওয়া। ধন্যবাদ। 

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.