নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত এবং মোকদ্দমা

ফৌজদারি আইন

রফিক সাহেবের একটি পুকুর রয়েছে, যেখানে তিনি মাছ চাষ করে নিজের আমিষের চাহিদা পূরণ করে থাকেন। উক্ত পুকুর তিনি পৈতৃক ভাবে নিজ পিতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এখন ওনার ছোট ভাই শফিক সাহবে দাবি করছেন যে, ঐ পুকুরে তারও অংশ রয়েছে এবং সে ঐ পুকুরে নিজ অংশের উপর বালি ফেলে ভরাট করে বিল্ডিং উত্তোলন করবেন। এমতাবস্থায় দুই ভাইয়ের মধ্যে পুকুরের মালিকানা নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। পারিবারিকভাবে সমঝোতা করার চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হয়, তখন বিরোধ নিস্পত্তির জন্য তারা আদালতের দ্বারস্থ হয়। তারা বলতে মূলত রফিক সাহেব আদালতে গিয়ে পুকুরের মালিকানা নিজের এই মর্মে ঘোষণামূলক মামলা দায়ের করে।

আমাদের দেশে দেওয়ানি মামলা তথা জমিজমার মামলাগুলো নিষ্পত্তি হতে যথেষ্ট সময় লাগে। মামলার জট এত বেশি যে মামলার এক তারিখ থেকে আরেক তারিখের মাঝখানে এক দুই মাস সময় চলে যায়। তার উপর আজ এই পক্ষের কেউ অসুস্থ তো কাল আরেক পক্ষের সময়ের আবেদন। এসব করে করে জমিজমার মামলা গুলো চলছে যুগের পর যুগ।

এদিকে রফিক সাহেব দেখলেন যে, শফিক সাহেব কিছুদিন পর পর পুকুরের দখল নেওয়ার জন্য বিভিন্ন পায়তারা করার চেষ্টা করছে। তার উপর টিপ্পনী তো আছেই, পথে ঘাটে যেখানেই দেখা হয় সেখানে ওই পুকুরে তার অংশের কথা বলে জুলুমবাজ বলে গালিগালাজের মাধ্যমে রফিক সাহেবকে বিরক্ত করে।

তার উপর শফিক সাহেব বাড়ি করার জন্য ইট, বালি, সিমেন্ট, রড ক্রয় করে নিয়ে আসেন। শফিক সাহেবের দাবি এই মামলা কতদিন চলবে আর আমি কতদিন বাড়ি না করে এভাবে বসে থাকব? এই পুকুর আমার বাবার ছিল, তাই এই পুকুরে আমারও হক রয়েছে। আমি অর্ধেক পুকুর ভরাট করে বাড়ি করে ফেলব অথবা পুকুরের পানি সেচে পুকুর থেকেই ফাউন্ডেশন তুলে পুকুরের উপরে আমার অংশে বাড়ি করে ফেলব।

রফিক সাহেব লক্ষ্য করে দেখলেন যে, পুকুরে তার চাষের মাছ রয়েছে। এখন যদি পানি সেচে পুকুর খালি করে ফেলা হয় তাহলে তিনি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অথবা যদি পুকুরে বালু ফেলে ভরাট করা হয় সেক্ষেত্রে তিনি ভবিষ্যতে এই বালি কেটে আবার পুকুর তৈরি করা বা উনার মালিকানার যে একচ্ছত্র অধিকার সেই অধিকার থেকে তিনি বঞ্চিত হতে পারেন। অন্যদিকে মামলা তো চলমান, মামলা নিষ্পত্তি হতে কত সময় লাগে তা বলা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় রফিক সাহেব কি করতে পারেন?

উপরের ঘটনাটি কাল্পনিক। এ ধরনের বিভিন্ন ঘটনা আমাদের আশেপাশে অহরহ ঘটে যাচ্ছে। মামলা চলমান অবস্থায় কোন এক পক্ষ বিরোধীয় সম্পত্তির মধ্যে কোন একটি উন্নয়নমূলক বা ক্ষতি সাধন মূলক কাজ করার চেষ্টা চালিয়ে গেলে সেক্ষেত্রে চলমান মামলাতেও আদালতের কাছ থেকে প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে।

সম্পত্তির মোকদ্দমা চলমান অবস্থায় আদালতের কাছে সাময়িক বা স্থায়ী ভাবে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া যায় এই মর্মে যে, যতদিন পর্যন্ত মামলার রায় আসছে না ততদিন পর্যন্ত উক্ত বিরোধীয় সম্পত্তিতে যাতে কোন ধরনের হস্তক্ষেপ কেউ ঘটাতে না পারে। একেই বলে নিষেধাজ্ঞার মোকদ্দমা। নিষেধাজ্ঞার মোকদ্দমা সবসময় স্বতন্ত্র মোকদ্দমা থাকে না, কখনো কখনো কেবল দরখাস্তের মাধ্যমেও নিষেধাজ্ঞা দাবী করা যেতে পারে। চলুন জানি বিস্তারিত।

নিষেধাজ্ঞা সাধারণত দুই প্রকার, যথা- অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা এবং স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা

অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে, মামলা চলাকালীন কোন নির্দিষ্ট সময় বা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা।  সাধারণত একটি সীমিত সময়ের জন্য যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় তাকে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বলা হয়। অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা পেতে কোন আলাদা মামলা করার দরকার পড়ে না। কোন চলমান মামলায় নিষেধাজ্ঞার জন্য দরখাস্ত দায়ের করলেই সেক্ষেত্রে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যেতে পারে।

দরখাস্ত করলেই যে নিষেধাজ্ঞা পেয়ে যাবেন তা কিন্তু নয়। দরখাস্ত দাখিলের পর আদালতের কাছে যদি এই মর্মে প্রতীয়মান যে, মামলার বিষয়বস্তু বিনষ্ট বা ধ্বংসের আশঙ্কা রয়েছে, সেক্ষেত্রে আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করতে পারেন।

অনেক সময় দেখা যায় যে, মামলা চলমান অবস্থায় বিরোধীয় সম্পত্তি কেউ বিক্রি করে দিতে চায় বা হস্তান্তর করে দিতে চায়। সেক্ষেত্রেও এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা যেতে পারে। অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, নালিশি বিষয়বস্তুর সংরক্ষণ। কোন পক্ষের স্বত্ব আছে কিনা তা নির্ণয় করা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য নয়। শুধুমাত্র মামলা যতদিন চলমান আছে বা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিরোধীয় সম্পত্তিতে যাতে কেউ কোন প্রকারের বিনষ্ট করতে না পারে, তার জন্যই এই অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা সাধারণত দেওয়া হয়ে থাকে।

এবার আসুন স্থায়ী নিষেধাজ্ঞার কাছে। স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা কিন্তু অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার মত একটি দরখাস্তর মাধ্যমে দায়ের করা হয় না। স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা নামের মধ্যেই রয়েছে স্থায়ী অর্থাৎ স্থায়ীভাবে যে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হবে তাকেই বলা হয় স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা। আমরা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞায় দেখেছিলাম যে, যতদিন মামলা চলমান আছে ততদিন অথবা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কিন্তু স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা স্থায়ী সময়ের জন্য জারি করা হয়ে থাকে।

সাধারণত সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৫৪ ধারা মোতাবেক স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চাইতে হয়। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে, স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষেত্রে মালিকানা প্রমাণ করতে হবে। যার ফলে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৫৪ ধারার সাথে ৪২ ধারার মামলা অর্থাৎ ঘোষণার মামলাও করা হয়ে থাকে। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী আপনার স্বত্ব ঘোষিত হলেই কেবল আপনি স্থায়ী নিষেধাজ্ঞার প্রতিকার পেতে পারেন।

আমাদের উপর উল্লেখিত ঘটনায় রফিক সাহেব যদি পুকুরের স্বত্বাধিকারী হয়, তখনি কেবল তিনি স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা পেতে পারেন। আর মামলা চলমান অবস্থায় বা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য যাতে শফিক সাহেব বা অন্য কেউ কোন প্রকার বিনষ্ট বা গণ্ডগোল করতে না পারে, তার জন্য অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চাইতে পারেন। আশা করি, নিষেধাজ্ঞা কি এবং নিষেধাজ্ঞার মোকদ্দমা কি সে সম্বন্ধে বুঝতে পেরেছেন, ধন্যবাদ।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.