আমরা প্রায় এই শব্দটা শুনে থাকি ‘এটেম্পট টু মার্ডার’/‘attempt to murder’ অর্থাৎ খুনের চেষ্টা/উদ্যোগ। কোন ব্যক্তিকে খুন করার জন্য কোন অপরাধ কর্মকাণ্ড চালানো হয়েছে কিন্তু ভাগ্যক্রমে লোকটি খুন হওয়া থেকে বেঁচে গেছে, তখন এই অপরাধ কর্মকাণ্ডকে আমরা ‘এটেম্পট টু মার্ডার’ অর্থাৎ খুনের উদ্যোগ/চেষ্টা বলে থাকি। অনেকেই এটাকে আবার half murder/হাফ মার্ডার ও বলে থাকে, অর্থ দাঁড়ায় ‘অর্ধেক খুন’। আসুন দেখি আমাদের আইনে অর্থাৎ দণ্ডবিধিতে একে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩০৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোন লোক এমন অভিপ্রায় বা অবগতি সহকারে বা এমন আশংকা জানার পরও এমন অবস্থায় এমন কার্য করে, যার ফলে মৃত্যু ঘটলে সে খুনের অপরাধে অপরাধী হবে, তাহলে সে লোক যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে যার মেয়াদ দশ বছর পর্যন্ত হতে পারে ও জরিমানা-দণ্ডেও দণ্ডিত হবে।
আবার, যদি কোন লোক এমন অভিপ্রায় বা অবগতি সহকারে বা এমন আশংকা জানার পরও এমন অবস্থায় এমন কার্যের সাহায্যে কোন লোককে আঘাত করে, যার ফলে মৃত্যু ঘটলে সে খুনের অপরাধে অপরাধী হবে, তাহলে সে লোক যাবজ্জীবন বা যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে যার মেয়াদ দশ বছর পর্যন্ত হতে পারে ও জরিমানা-দণ্ডেও দণ্ডিত হবে।
তবে যদি ইতিমধ্যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তিকে খুনের চেষ্টা বা উদ্যোগ করে, তবে সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে শাস্তি হবে একমাত্র মৃত্যুদণ্ড।
শাস্তির বিধান তো গেলো, এখন আসা যাক কিছু উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করা যাক। আসলে কোন কোন কাজ খুনের চেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত হবে আর কোন গুলো খুনের চেষ্টা হবে না, সেগুলো সম্বন্ধে জানা যাক। কেননা, আমাদের সমাজে মামলা করার সময় সবসময় বাড়িয়ে বাড়িয়ে দেখানো হয়। চুরি করে দস্যুতা বা ডাকাতি হিসেবে, আঘাত কে গুরুতর আঘাত হিসেবে, গুরুতর আঘাতকে খুনের চেষ্টা হিসেবে দেখিয়ে থানায় মামলা দায়ের করা হয়। মনে করা হয় যে, বাড়িতে দেখালেই মামলা জেতা যায় বা আসামীর বেশি শাস্তি হবে। অথচ, ভালো উকিলের হাতে পড়লে এইসব মামলা চার্জ গঠনের সময়ই ডিসচার্জ হয়ে যায়। আসামীকে বেশি শাস্তি দিতে গিয়ে পুরো মামলাটাই খারিজ হয়ে যায়। আপনাকে বুঝতে হবে, মামলা দায়ের করার আগে যে অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলে মামলা দায়ের করবেন, সেই অপরাধ সংগঠনের জন্য যেসব ইলিমেন্ট বা গ্রাউন্ড দরকার, সেগুলো বাস্তবে ঘটেছিল কিনা। কারণ, মামলা তো করে ফেলবেন অতি উৎসাহে কিন্তু প্রমাণও যে আপনাকে করতে হবে। প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলে আপনাকে সেই পুরনো ডায়লগ শুনতে হবে যে, ঘটনা সত্য, কিন্তু আসামী নির্দোষ। অর্থাৎ, আপনাকে যে আঘাত করেছে, সেটা সত্য; কিন্তু ভুল ধারায় মামলা করার কারণে আসামী নির্দোষ।
আরেকটি ছোট টোটকা বলি, আমাদের দণ্ডবিধি অনুসারে দস্যুতা আর ডাকাতি একই অপরাধ, শুধু পার্থক্য হচ্ছে অপরাধীর সংখ্যায়। অপরাধী যখন ৪ বা ৪ এর নীচে, তখন এটা দস্যুতা। কিন্তু, যখন অপরাধী ৫ বা তার বেশি তখন সেটা ডাকাতি। এখন আপনি ২ মিলে ডাকাতি করেছে বা ৬ জন মিলে দস্যুতা করেছে বলে যদি ভুল ধারায় মামলা করেন, তবে সেটি কি হবে বুঝতেই পারছেন। তাই, প্রথমে প্রকৃত অপরাধটি চিহ্নিত করতে হবে, তারপর ধারা সিলেক্ট করতে হবে।
খুনের চেষ্টায় কেউ অপরাধী হবে যদি সে এমন কোন কাজ করে, যার ফলে কোন ব্যক্তির মৃত্যু হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। যেমন ধরুন, কেউ একজন আপনার অতি অল্প বয়স্ক শিশুর মৃত্যু ঘটাবার ইচ্ছায় তাকে একটি মরু প্রান্তরে রেখে আসে, এতে যদিও শিশুটির মৃত্যু না ঘটে তবুও এটি খুনের চেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হবে।
আবার, কেউ একজন আপনাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বিষ করে তা খাবারে মিক্স করে; এতটুকুই খুনের চেষ্টার জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু, যদি ঐ লোক ঐ বিষ মিক্স করা খাবার আপনার টেবিলে দেয় বা আপনার টেবিল পর্যন্ত যেকোনো ভাবে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে, তখনি ঐ লোক খুনের চেষ্টার জন্য অভিযুক্ত হবে।
খুনের চেষ্টা আর খুনের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হলে 40 DLR (AD) 6 এ নজর দিতে হবে। এতে বলা হয়েছে যে, “গুরুতর জখমের দ্বারা মৃত্যু ঘটার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও ক্ষেত্র বিশেষে শিকারি লোক ভাগ্যচক্রে বেঁচে যেতে পারে; অনুরূপ ক্ষেত্রে, হত্যার চেষ্টা কিংবা উদ্যোগ ছিল বলে বিবেচিত করা হয়ে থাকে। খুন করার উদ্দেশ্যে দৃঢ়ভাবে আক্রমণ ও আহত করার পরও যদি কোন লোক বেঁচে যায়, তা হলে আক্রমণকারীদেরকে খুনের উদ্যোগে দোষী সাব্যস্ত করা যায়। খুনের উদ্যোগ ছাড়া জখম করলে তা দণ্ডবিধির ৩২৪ থেকে ৩২৬ ধারার আওতায় জখম বলে বিবেচিত হবে। ক্ষেত্র বিশেষে আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা-কালীন অতিরিক্ত আই.ভি.ইনফিকশন দেওয়ার ফলে মারা যেতে পারে। কিংবা গুরুতর অপারেশনের ফলে মারা যেতে পারে। অনুরূপ ক্ষেত্রে আসামীদের অপরাধকে কিছুটা নমনীয় ভাবে দেখতে হয়। অর্থাৎ, দণ্ডবিধির ৩০২ ধারার(খুন) পরিবর্তে ৩০৭ ধারা(খুনের চেষ্টা) মোতাবেক তুলনামূলক কম শাস্তি প্রদান করা যায়”।
আবার অনেকে মনে করেন যে, খুনের চেষ্টার জন্য যে অপরাধটি ঘটেছিল সেটি যদি পরিপূর্ণ ভাবে সম্পন্ন হতো, কিন্তু হয়নি তবেই কেবল সেটিকে খুনের চেষ্টা বলা যাবে। কিন্তু 7 DLR 430 এ বলা হয়েছে যে, “দণ্ডবিধির ৩০৭ ধারার অপরাধ প্রমাণের জন্য এটা প্রমাণ করার দরকার হবে না যে, আসামীর নিক্ষিপ্ত আঘাতের ফলে ভিকটিমের মৃত্যু অনিবার্য ছিল”।
অর্থাৎ, কোন আঘাত না প্রদান করা হলেও খুনের চেষ্টার অপরাধ হতে পারে আক্রমণকারী খুন করার ইচ্ছা পোষণ করে খুনের চেষ্টা করেছিল বলে প্রমাণ করতে পারলে যথেষ্ট হবে।
উল্লেখ্য, খুনের চেষ্টার অপরাধ আমলযোগ্য, ওয়ারেন্ট-যোগ্য, আপোষ-যোগ্য নয়।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )