আমরা সাধারণত জানি যে, যেকোনো ধরনের মামলায় যখন সাক্ষ্যপ্রমাণ শেষে আদালত কোন রায় প্রদান করেন, তখন আদালতের রায়ে যদি কোনো পক্ষ সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকে সেই ক্ষেত্রে ওই সংক্ষুব্ধ পক্ষ উচ্চতর আদালতে আপিল করতে পারেন। একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আপীলের মাধ্যমে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে নিম্ন আদালতের রায় সম্পূর্ণ পরিবর্তন করতে পারেন। যেমন, নিম্ন আদালতে যদি কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে নির্দিষ্ট মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়ে থাকে, সেই ক্ষেত্রে তিনি যদি নির্দোষ ব্যক্তি হয়ে থাকেন এবং তিনি আপীল করলে এবং নিজের পক্ষে যথাযথ সাক্ষ্য প্রমাণ পেশ করতে পারলে উচ্চতর আদালতে তিনি খালাস পেতে পারেন। আবার একজন অপরাধী ব্যক্তি যদি যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে নিম্ন আদালতে খালাস পেয়ে যায়, সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ বা অভিযোগকারী পক্ষ উচ্চতর আদালতে আপিল করলে উক্ত দোষী ব্যক্তিকে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত করে নির্দিষ্ট মেয়াদের শাস্তি প্রদান করতে পারেন। এমন কি কোন ব্যক্তি যদি দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরেও তাকে আদালত যে মেয়াদের শাস্তি প্রদান করেছেন সেই মেয়াদে শাস্তিতে যদি অভিযোগকারী বা রাষ্ট্রপক্ষ সন্তুষ্ট না থাকেন, তাহলে ওনার এই অপর্যাপ্ত দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করে শাস্তির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য আবেদন করতে পারেন উচ্চতর আদালতে বরাবর। উচ্চতর আদালত সন্তুষ্ট হলে, আদালত শাস্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করে দিতে পারেন।
দেওয়ানী মামলা হোক আর ফৌজদারি মামলা, উভয় মামলাতেই আদি আদালত যে রায় দিবেন তার বিপরীতে উচ্চতর আদালতে আপিল করা যায়; কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, আদি আদালত অর্থাৎ নিম্ন আদালত যে রায় দিয়ে থাকেন, সেই রায়ের বিপরীতে আর আপিল করা যায় না। উল্লেখ্য এখানে আমরা শুধুমাত্র ফৌজদারি অর্থাৎ ক্রিমিনাল মামলায় যেক্ষেত্রে আপিল চলে না বা আপিল করা যায় না সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪১২, ৪১৩ এবং ৪১৪ ধারায় আলোচনা করা হয়েছে যেসব ক্ষেত্রে আপিল দায়ের করা যাবে না সেসব বিষয় নিয়ে। চলুন জানি, একে একে ৩ টি ধারা।
প্রথমেই আসা যাক ৪১২ ধারায়। ৪১২ ধারায় বলা হয়েছে যে কোন ব্যক্তি যদি দোষ স্বীকার করে অর্থাৎ একজন অপরাধীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে উক্ত অভিযোগ সে যদি আদালতে নিজেই স্বীকার করে সেই ক্ষেত্রে আদালত তাকে যেই দণ্ড প্রদান করবেন, সেই দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন না। ধরুন আপনার মোবাইল ফোনটি চুরি করা হয়েছে, আপনি মামলা করলেন এবং উক্ত মামলায় বিচারকার্য চলমান অবস্থায় আসামি নিজেই স্বীকার করল যে তিনি ওই মোবাইলটা চুরি করেছেন। সাধারণত কি হয়, অপরাধী যদি নিজের দোষ স্বীকার করে নেয় সে ক্ষেত্রে মামলার বিচারকার্যের সময় অপচয় হয় না, কিন্তু আসামি স্বীকার না করলে তখন যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ, জবানবন্দি, জেরা, পুনঃ জবানবন্দি, পুনরায় জেরা, আর্গুমেন্ট পুরো কার্য পদ্ধতি অনুসরণ করার পরে আদালতে মামলার রায় ঘোষণা করতে হয়। কিন্তু যখন আসামী নিজেই অপরাধের কথা স্বীকার করে নেয়, সে ক্ষেত্রে আদালতের সময় বেঁচে যায় যার ফলে আদালত আসামীর দোষ স্বীকারের উপর ভিত্তি করে এবং দয়া প্রদর্শন করে কিছুটা লঘু শাস্তি প্রদান করে থাকেন। তাই যদি কোনো আসামি দোষ স্বীকার করে এবং দোষ স্বীকারের উপর ভিত্তি করে আদালত রায় প্রদান করেন তাহলে উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে আসামি আপিল করতে পারবে না। কিন্তু দোষ স্বীকারের কারণে আদালত যে দণ্ড প্রদান করেছেন, সেই দণ্ডের পরিমাণ অধিক হয়েছে বলে যদি মনে হয়, তাহলে উক্ত দণ্ড হ্রাস করার উদ্দেশ্যে যদি আপীল করতে চায়, সেই ক্ষেত্রে আপীলে কোন বাধা নেই।
এবার আসা যাক ৪১৩ ধারায়। ৪১৩ ধারায় বলা হয়েছে যে, তুচ্ছ মামলায় আপীল করা যাবে না। এখন তুচ্ছ মামলা বলতে কী বোঝায়, এখানে তুচ্ছ মামলা বলতে মামলার রায়ে শাস্তির পরিমাণের উপর ভিত্তি করে তুচ্ছ মামলাকে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তুচ্ছ মামলাকে আবার ৩ টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে বা ৩ টি স্তরে বিন্যাস করা হয়েছে।
প্রথমত: যদি দায়রা আদালত অনধিক এক মাসের কারাদণ্ড প্রদান করে অর্থাৎ কারাদণ্ডের মেয়াদ এক মাসের বেশি না হয়, সেই ক্ষেত্রে আপিল করা যাবে না।
দ্বিতীয়তঃ দায়রা আদালত বা চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা অন্য যেকোনো প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট অনধিক ৫০ টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করেন অর্থাৎ ৫০ টাকার বেশি নয় এমন অর্থ দণ্ড প্রদান করেন, সেই ক্ষেত্রে সেই অর্থদণ্ডের বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে না।
তৃতীয়তঃ যদি আদালত শুধুমাত্র জরিমানা আরোপ করে এবং ওই জরিমানা প্রদানে ব্যর্থতার কারণে আদালত কোন দণ্ড প্রদান করে থাকেন, সেই ক্ষেত্রে সেই দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না।
এবার আসা যাক ৪১৪ ধারায়। ৪১৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, সামারি ট্রায়াল অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত যে বিচার সেই বিচারে যদি ম্যাজিস্ট্রেট অনধিক ২০০ টাকা জরিমানার আদেশ দিয়ে থাকেন অর্থাৎ জরিমানা ২০০ টাকার বেশি নয় সেই ক্ষেত্রে ওই জরিমানা আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে না।
উল্লেখ্য, ৪১৩ ধারায় বলা হয়েছে ৫০ টাকার বেশি নয় এমন অর্থদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না কিন্তু ৪১৪ ধারায় বলা হয়েছে অনধিক ২০০ টাকা অর্থাৎ ২০০ টাকার বেশি নয় এমন জরিমানার বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে না। এই বিষয়টি নিয়ে আপনার যদি কনফিউশন তৈরি হয়, তাহলে একটু মনোযোগ দিয়ে আবার পড়ুন। অনধিক ৫০ টাকার বিষয়টি হচ্ছে ‘দণ্ড’ এবং সেটি হচ্ছে রেগুলার আদালত কর্তৃক, কিন্তু ২০০ টাকার জরিমানা হচ্ছে সামারি ট্রায়াল অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত বিচারের ক্ষেত্রে।
উপরে উল্লেখিত তিনটি ধারাতে যদি আপনি দণ্ডিত হয়ে থাকেন, সেই ক্ষেত্রে আপনি আপিল করতে পারবেন না ঠিকই তবে আপনি রিভিশন করতে পারবেন। কেননা আইন অনুসারে যেখানে আপিল করা যায় না সেখানেই রিভিশন দায়ের করা যায়। আশা করি, খুব সহজ ভাষায় কখন ফৌজদারি আপীল দায়ের করা যায় না, সেই বিষয়টি ক্লিয়ার হয়ে পেরেছেন। ধন্যবাদ।

চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেল সম্বন্ধে আপনার কোন মতামত জানাতে, মোবাইল: 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )