দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানোর নিয়ন্ত্রণ আইন

বিবিধ আইন

বাংলাদেশে দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানোর প্রচলন বহু পুরনো। বিশেষ করে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো জনগণকে সংগঠিত করার এবং মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান প্রচারের জন্য। ১৯৭১ সালে বিভিন্ন দেওয়ালে স্বাধীনতার দাবি এবং মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান লেখা হতো, যা জাতির মনোবল বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল।

স্বাধীনতার পর থেকে, দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো রাজনৈতিক প্রচারণার একটি সাধারণ কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনগুলো নির্বাচনী প্রচারণা, আন্দোলন, এবং দাবি-দাওয়ার ক্ষেত্রে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। তবে সময়ের সাথে সাথে এই মাধ্যমটি অনেক সময় অপব্যবহার ও নগরীর সৌন্দর্যহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যা মোকাবেলায় ২০১২ সালে “দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন” প্রণয়ন করা হয়, যা এই প্রচলিত প্রচারণার মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। 

দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২ নামে পরিচিত এই আইনটি সারা বাংলাদেশে প্রযোজ্য হবে। অন্যান্য আইনের ন্যায় উক্ত আইনের ২ ধারায় দেওয়াল, পোস্টার, এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোর সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। যেমনঃ 

দেওয়ালঃ দেওয়াল বলতে ইট, পাথর বা অন্য কোনো নির্মাণকাজের জন্য ব্যবহৃত স্থাপনা বোঝায়। তবে, শুধুমাত্র বাড়ির দেওয়াল নয়, এতে বিদ্যুতের খুঁটি, সড়ক বিভাজক, সেতু, কালভার্টসহ অন্যান্য অবকাঠামোও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার একটি অফিস ভবনের বাইরে সড়ক বিভাজকের উপর পোস্টার লাগালে সেটিও এই আইনের আওতায় পড়বে।

পোস্টারঃ পোস্টার বলতে লিখিত, মুদ্রিত বা আঁকা যে কোনো ধরনের প্রচারণা বোঝানো হয়েছে, যা দেওয়ালে লাগানো হয়। এটি বিজ্ঞাপন, রাজনৈতিক প্রচারণা বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে হতে পারে।

দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগাতে অনুমতির প্রয়োজনঃ দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২ এর ধারা ৪(১) অনুযায়ী, দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানোর জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি আবশ্যক। অনুমতি ছাড়া যদি কেউ এই কাজ করে, তবে এটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি ঢাকার মিরপুর এলাকার কোনো বাড়ির দেওয়ালে অনুমতি ছাড়াই রাজনৈতিক পোস্টার লাগানো হয়, তবে সেটি এই ধারার অধীনে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। 

দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২ এর ধারা ৪(২) এ আলোচনা করা হয়েছে স্থান নির্ধারণ প্রসঙ্গে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত স্থানে দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানোর অনুমতি দিতে পারে। এই অনুমোদন কেবলমাত্র নির্দিষ্ট কিছু স্থানের জন্য প্রযোজ্য হবে। যেমন, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন শহরের কিছু নির্দিষ্ট স্থানে পোস্টার লাগানোর জন্য অনুমতি প্রদান করতে পারে, কিন্তু এর বাইরে অন্য কোনো স্থানে অনুমতি ছাড়াই পোস্টার লাগানো যাবে না।

দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২ এর ৫ ধারায় বিদ্যমান দেওয়াল লিখন বা পোস্টার অপসারণ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। এই আইন কার্যকর হওয়ার পর পূর্বের বিদ্যমান দেওয়াল লিখন বা পোস্টার অপসারণের জন্য সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করবে। এই সময়সীমার মধ্যে দেওয়াল বা পোস্টার অপসারণ করতে হবে। যদি অপসারণ না করা হয়, তবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে তা অপসারণ করবে এবং খরচ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে আদায় করবে। উদাহরণস্বরূপ, চট্টগ্রামের একটি স্কুলের দেওয়ালে পুরনো একটি পোস্টার থাকলে, সেটা মুছে ফেলার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হবে।

দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২ এর ৬ ধারায় এই আইনের অধীন অপরাধ এবং এর দণ্ড নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সাধারণ দণ্ড হিসেবে অনুমতি ছাড়া দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানোর জন্য অপরাধীকে ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং অনাদায়ে ১৫ দিনের কারাদণ্ড প্রদান করা হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গাজীপুরের একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের দেওয়ালে অনুমতি ছাড়াই বিজ্ঞাপন পোস্টার লাগানোর জন্য মালিককে ১০,০০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

আর বিশেষ দণ্ড হিসেবে, যদি একই ব্যক্তি বারবার এই আইন লঙ্ঘন করেন, তবে দণ্ড আরও কঠোর হতে পারে। পুনরায় অপরাধ সংঘটিত হলে, আগের জরিমানার পরিমাণ দ্বিগুণ করা হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি ঢাকার একটি এলাকায় কোনো ব্যক্তি বারবার দেওয়ালে পোস্টার লাগিয়ে থাকে, তবে তাকে পুনরায় জরিমানা করলে, আগের জরিমানার দ্বিগুণ করা হবে।

দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২ এর ৭ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, যদি কোনো জরুরি অবস্থা বা বিশেষ পরিস্থিতি ঘটে, তবে সরকার এই আইনের নির্দিষ্ট কিছু বিধান অস্থায়ীভাবে স্থগিত করতে পারে। যেমন, মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এই আইনের কিছু বিধান সাময়িকভাবে স্থগিত করা যেতে পারে।

দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২ এর ৮ ধারায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ যদি কোনো অবৈধ দেওয়াল লিখন বা পোস্টার দেখতে পায়, তবে তারা তাৎক্ষণিকভাবে তা অপসারণ করতে পারে এবং দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় যদি কোনো বাড়ির দেওয়ালে অনুমতি ছাড়া পোস্টার লাগানো হয়, তবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সেই পোস্টার অপসারণ করতে পারে।

দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২ এর ধারা ৯ এ নির্বাচনী প্রচারণার জন্য বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে। ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনের সময় দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানোর জন্য নির্বাচন কমিশনের বিশেষ নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে। এই নির্দেশনা অনুসরণ করে প্রার্থীরা নির্দিষ্ট স্থানে প্রচারণা চালাতে পারবেন। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত কিছু স্থান নির্বাচন প্রচারণার জন্য বরাদ্দ করতে পারে।

৯(২) ধারা মতে, নির্বাচনী প্রচারণা শেষে প্রার্থীদের পোস্টার ও দেওয়াল লিখন অপসারণ করতে হবে। যদি প্রার্থীরা তা না করেন, তবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে তা অপসারণ করবে এবং খরচ সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর থেকে আদায় করবে। যেমন, সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর প্রার্থীদের পোস্টার না সরানো হলে কর্তৃপক্ষ তা অপসারণ করে এবং খরচ আদায় করে নেয়।

দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২ বাংলাদেশের নগরায়ণ ও পরিবেশ রক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে শহরের সৌন্দর্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা সম্ভব হবে। 

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.