যারা আইনানুগ প্রক্রিয়া ব্যতিরেকে নিজের গলায় নিজে ফাঁসি দিয়ে নিজের ইহকাল পরকাল উভয়ই হারায়, তাদের কথা আমরা ঠিক আলোচনা করছি না। আমরা আলোচনা করছি, আইনানুগ প্রক্রিয়ায় যাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয় তাদেরকে নিয়ে। সাধারণত আইনানুগ প্রক্রিয়ায় যখন কারো ফাঁসি দেওয়া হয় সেই দৃশ্যটা আমাদের দেখার সুযোগ হয়ে উঠে না। তারপরও আমরা সিনেমায় দেখে থাকি যে, একজন ব্যক্তিকে যখন ফাঁসি দেওয়া হয় তখন তার মাথা থেকে গলা পর্যন্ত একটা কালো কাপড় কান টুপির মতো পরানো হয় যেটা দিয়ে চোখ মুখ ঢেকে দেওয়া হয়। তাছাড়া তার দুই হাত পিছনে নিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। সবশেষে উপর থেকে ঝুলে থাকা নতুন সাদা দড়ি তার গলায় লাগানো হয় এবং বরাবর ১২ টায় একজনের হাত থেকে একটা রুমাল পড়ে যাবে আর সাথে সাথেই ফাঁসি কার্যকর হয়। সময়মতো তার পায়ের নিচে থাকা পাটাতনটা খুলে যায়। এরপর নির্দিষ্ট সময় পরে তার যখন মৃত্যু নিশ্চিত হয় তখন তার মৃতদেহ তার আত্মীয়-স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয় বা জেল কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে আত্মীয়স্বজনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজটুকু করে থাকে। কিন্তু এই যে ফাঁসির কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় তখন যে দড়ি দিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়, সেই দড়িতে কেন মোম লাগানো হয়ে থাকে, এই প্রশ্নটিই আপনার আমার মনে আসতে পারে। যদিও এই অনুচ্ছেদ পড়ার আগ পর্যন্ত অনেকেরই হয়তো জানাই ছিল না যে, ফাঁসির দড়িতে মোম লাগানো হয়ে থাকে। কিন্তু আপনি জানলে অবাক হবেন যে, আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী বেশি সময় আগে (১৯০৮ সালে) কেউ একজন নিজে ফাঁসিতে ঝোলার ঠিক আগ মুহূর্তে জল্লাদকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন?’
ইতিহাস সম্বন্ধে জানা শোনা থাকলে আশা করি এখন আপনার মনে পড়ছে কে সেই ব্যক্তি, যার মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও জানার ইচ্ছে ছিল প্রবল, তাও কিনা আবার নিজে যে দড়িতে ঝুলে ঝুলে মৃত্যুবরণ করবেন সেই দড়িতে কেন মোমবাতি লাগানো হয় সেই বিষয় নিয়ে। জি হ্যাঁ, তিনি আর কেউ নন, তিনি শহীদ ক্ষুদিরাম বসু। ওনাকে ভারতের কনিষ্ঠতম বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন। এক শতাব্দীরও আগে থেকে যে প্রশ্নটিই এখনো আমাদের মনে কৌতূহল তৈরি করে সেই প্রশ্নটির উত্তর ততটা কঠিন নয় বরং যথেষ্ট মানবিক। এই প্রশ্নটির উত্তর জানার আগে আরও একটি কথা বলে রাখা ভালো যে, ক্রমেই পৃথিবী থেকে মৃত্যুদণ্ডকে শাস্তি হিসেবে প্রয়োগ করার প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে উঠিয়ে দেওয়া শুরু হতে যাচ্ছে। প্রমাণস্বরূপ, ইতিমধ্যে ১০৬ টি দেশে মৃত্যুদণ্ডকে ইতিমধ্যে রহিত করা হয়েছে, মাত্র ৫৬ টি দেশে মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে, যার মধ্যে আবার ২৮টি দেশে কাগজে-কলমে মৃত্যুদণ্ড উপস্থিত থাকলেও বাস্তবে প্রয়োগ নেই।
যারা এখনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করছে না আবার মৃত্যুদণ্ড রহিতও করছে না, তাদের পক্ষে যুক্তি হচ্ছে এখনো পৃথিবীতে কিছু কিছু মারাত্মক অপরাধ হচ্ছে, সেগুলোর জন্য হলেও মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা উচিত। যেমন যুদ্ধাপরাধী, দেশদ্রোহী, গুপ্তচরবৃত্তি, হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি অপরাধের জন্য আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত। অন্যথায় দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা রোধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড যেহেতু একটি প্রাণের সমাপ্তি, সে ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডকে শাস্তি হিসেবে দেওয়ার জন্য অনেকেরই ঘোর আপত্তি থেকে থাকে। বিশেষ করে আমরা যেহেতু প্রতিটি মৃত্যুদণ্ডের আগে ১০০% নিশ্চিত হয়ে কোন ব্যক্তির ফাঁসির আদেশ দিতে পারি না, কেননা প্রত্যেকটি মামলার রায় দেওয়ার সময় বিচারকগণ যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়ার স্বত্বেও কখনো কখনো কোনো কোনো রায় নিয়ে বিশেষ করে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত নিয়ে জনগণের মধ্যে দ্বিধা বিভক্তি বা সন্দেহ থেকে যায়। কারণ বিচারক কিন্তু অনুসন্ধান করেন না, করেন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আর অনুসন্ধান যেভাবে হবে মামলার রায় ঠিক ঐ পথেই হাঁটবে। আর ক্রিমিনাল মামলার রায় দিতে হয়, কোন প্রকার সন্দেহ ব্যতিরেকে, ইংরেজিতে যাকে বলে beyond reasonable doubt, কোন সন্দেহ থাকলে সেই সুবিধা পাবে আসামী, (benefit of doubt goes to accused. যার ফলে কোনো প্রকার সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও যখন কোন ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় বা ফাঁসি কার্যকর করা হয়, তখন সেটা জনমনে বেশ প্রভাব বিস্তার করে।
ব্রুস ম্যাক আর্থার নামে কানাডার একজন ছিল, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর থেকে কানাডাতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া বা মৃত্যুদণ্ডকে শাস্তি হিসেবে আর রাখা হয় নি। কেননা ম্যাক আর্থার যে খুনের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল এবং যেভাবে খুনের তদন্ত করা হয়েছিল এবং উক্ত তদন্তের ভিত্তিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে তদন্তের বিষয়টি নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি দেখা দিয়েছিল এবং পুলিশের দেওয়া রিপোর্ট অনুসারে সেখানে কিছু গড়মিল খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু ততক্ষণে ম্যাক আর্থারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। এভাবে বিতর্কিত একটি তদন্ত থেকে কারো ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, যেটা কিনা যে কারো সাথে ঘটতে পারে, এই চিন্তা কানাডার সিটিজেনদের জন্য মানসিকভাবে বেশ হুমকিস্বরূপ ছিল, যার প্রভাব পুরো দেশে বিশেষ করে আইন প্রণেতাদের মধ্যেও পড়েছিল। যার ফলে তখনি কানাডাতে মৃত্যুদণ্ডকে রহিত করা হয়েছে। যেহেতু একটি সন্দেহ থেকে যায় সে ক্ষেত্রে একটি ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া সমীচীন মনে করা হয়। তাছাড়া, কারাদণ্ডে থাকা অবস্থায় সে অনুশোচনা করতে পারে, সমাজ সেবা করতে পারে, বাকিদেরকে একই কাজ না করতে বলতে পারে। যাই হোক, একজন সিরিয়াল কিলারের ক্ষেত্রেও যদি এতোটুকু মানবতা কানাডার সিটিজেনরা দেখাতে পারে, সে ক্ষেত্রে একজন সত্যিকার খুনির ফাঁসি দেওয়ার আগে তার মৃত্যু যেহেতু নিশ্চিত, অন্তত মৃত্যুতে তার কষ্টটা যাতে লাঘব করা হয় অর্থাৎ কম কষ্টে যাতে সে মারা যায়, সেই ব্যবস্থাটুকু করার জন্য জেলার কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকেন। যার ফলশ্রুতিতে ফাঁসির দড়িতে পিচ্ছিল পদার্থ ব্যবহার করা হয়, সে ক্ষেত্রে মোম, ঘি, তেল ইত্যাদিকে সবচেয়ে বেশি উপযোগী মনে করা হয়। এতে ফাঁসির দড়ি গলার মধ্যে খুব সহজেই বসে যায় এবং খুব বেশি কষ্ট ছাড়াই ওই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা যায়। রেফারেন্সের স্বার্থে বলে রাখা ভালো, ১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট ক্ষুদিরাম বসু নিজের ফাঁসির ঠিক আগ মুহূর্তে এই প্রশ্নটা করেছিল জল্লাদকে।
শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে রাখা উচিত কি উচিত নয় সেটি নিয়ে এখনো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিতর্ক চলছে। যারা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন মৃত্যুদণ্ড শাস্তি হিসেবে রাখা উচিত নয়, তারা ইতিমধ্যে রহিত করেছেন। আর যারা এখনও রহিত করেননি, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো তারাও ধীরে ধীরে রহিত করার প্রক্রিয়ায় যাবেন। তবে যখন কোন ব্যক্তি খুন হয় বা কোন ব্যক্তি যুদ্ধাপরাধ করে বা কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতা করে বা কোন ব্যক্তি গুপ্তচর ভিত্তিক কোন কাজ করে তখন আসলেই তার জন্য prima facie মৃত্যুদণ্ড শাস্তিটাই মাথায় আসে। কিন্তু প্রত্যেকটা ব্যক্তির অপরাধ করার সময় আর পরিস্থিতি বিবেচনা করেই তার শাস্তি কার্যকর করা উচিত। কারো কারো মতামত হচ্ছে, শুধুমাত্র ঠাণ্ডা মাথার খুনি বা প্রথম ডিগ্রী খুনিদের জন্য মৃত্যুদণ্ডটা হয়তো রাখা যেতে পারে।
আমরা যারা এই প্রশ্নের উত্তরটি জানতাম না তার আশা করি এটা বুঝতে পেরেছি যে, একটি লোক যত বড় অপরাধী হয়ে থাকুক না কেন, মৃত্যু যখন তার নিশ্চিত অর্থাৎ তার বিদায় বেলায় তাকে যতটা কম কষ্ট দিয়ে বিদায় দেওয়া যায়। তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?- সে খুন করেছে নিষ্ঠুরের মতো কিন্তু আমরা তাকে বিদায় দিবো মানবতার সাথে। আর, একজন খুনিকে ফাঁসি দিতে যখন আমরা এতটুকু মানবতা প্রকাশ করতে পারি, কেন একজন নিরপরাধী মানুষকে আমরা অন্যায়ভাবে খুন করবো? মৃত্যুদণ্ড তো রহিত করা যাবে, কিন্তু খুন?- অথচ খুন বন্ধ হয়ে গেলে মৃত্যুদণ্ড আপনাআপনিই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। দিন শেষে, যতটুকু সম্ভব আইন মেনে চলা উচিত। আর আইন মানতে হলে, আগে আইন জানতে হবে; আর তার জন্য আমাদের সাথে অর্থাৎ Legal Fist – এর সাথে থাকতে হবে। ধন্যবাদ।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )