স্বামী মৃত্যুর এক বছর এক বিধবা নারী শারীরিক অসুস্থতা অনুভব করছেন বলে ডাক্তার দেখাতে গেলে তখন বিভিন্ন চেক আপ শেষ ক্লিনিক থেকে জানানো হল যে, তিনি নাকি ৪ মাসের গর্ভবতী। স্বামী মৃত্যুর এক বছর তিনি কীভাবে গর্ভবতী হলেন আর এখন এই সন্তানের পিতাই বা কে?
আমাদের সমাজ কিছু দিন আগেও বেশ রক্ষণশীল ছিল এবং ডাক্তারি বিদ্যা উন্নত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সন্তানের বৈধতা নিয়ে বেশ প্রশ্ন উঠত। অনেক সময় অনেকেই সন্তানের চেহারা বা শারীরিক কাঠামো দেখে নিজের সন্তান নয় বলে দাবী করবেন আবার অনেকেই প্রবাসে বা নিজ স্ত্রী থেকে অনেক দিন দূরে থাকা সত্ত্বেও যখন স্ত্রী গর্ভবতী হতো, তখন সেই সন্তানের পিতা নিয়ে জটিলতা তৈরি হতো। এখন সন্তানের পিতৃ পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই ডিএনএ (Deoxyribonucleic acid, or DNA) টেস্টের মাধ্যমে দুশ্চিন্তা দূর করা যায়। তাছাড়া, কোন গর্ভবতী নারী যখন বুঝতে পারে তার গর্ভে থাকা সন্তান তার আইনগত স্বামীর ঔরসজাত নয়, তখন গোপনে গর্ভপাত (Abortion) করিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলে; যা কিনা বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
তবে, আজ থেকে শত বছর পূর্বে যখন ব্রিটিশরা আমাদের দেশে শাসন করতো এবং আইন প্রণয়ন শুরু করে, তখন কিন্তু মেডিক্যাল সাইন্স এতো উন্নত ছিল না বলে আইনের বেড়াজালেই সবকিছুর সমাধান করা লাগতো। তাই, ১৮৭২ সালে সাক্ষ্য আইন যখন প্রণয়ন করা হয় তখন দিনের হিসেবে সন্তানের বৈধতা প্রদান করা হতো এবং এই দিন গুনেই প্রমাণ করা হতো কে বৈধ সন্তান আর কে অবৈধ সন্তান। বিষয়টি নির্মম কিনা সেটি আজকের দিনে বসে পাঠক নিজেই ঠিক করতে পারবেন।
সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এর ১১২ ধারায় সন্তানের বৈধতা (Legitimacy of Child) নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এটিকে সন্তানের বৈধতার অনুমান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। যখনি কোন সন্তানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে তখন এই সন্তান বৈধ কিনা সেটি যাচাই করার জন্য, সাক্ষ্য আইনের ১১২ ধারা অনুযায়ী, আদালত সন্তানটিকে বৈধ হিসেবে অনুমান করবেন যদি ২ টি শর্তের কোনটি পূরণ করা হয়।
এক, যে সন্তানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তার বাবা মায়ের মধ্যে বৈধ বৈবাহিক সম্পর্ক স্থির বা বলবত থাকাকালীন তার জন্ম হয়েছে কিনা।
দুই, বাবা মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাকের ২৮০ দিনের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে কিনা এবং উক্ত ২৮০ দিনের মধ্যে তার মা অবিবাহিত ছিল কিনা।
উপরে উল্লেখিত দুই শর্তের যে কোন একটি যদি পূরণ করে কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করে, তবে ঐ স্ত্রী এবং স্বামীর বৈধ সন্তান হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এটি তার চূড়ান্ত প্রমাণ যা আদালতের ভাষায় conclusive proof.
এই তো গেলো আইনের ভাষ্য, কিন্তু এখন দেখা যাক আইনটি আজকের দিনে কতটা বাস্তবসম্মত।
সাক্ষ্য আইনের ১১২ ধারা নিয়ে আমার বেশ আপত্তি রয়েছে। প্রথমত, সন্তান বৈধ নাকি অবৈধ; এই শব্দ চয়নটিই বেশ আপত্তিকর। ভুল বা অন্যায় করে থাকলে সেটি করছে তার বাবা কিংবা মা। তার জন্য সন্তানকে কে অবৈধ বলা হবে, এটাই আমার বোধগম্য নয়। একজনের কর্মফলের জন্য অন্য জনকে দোষারোপ করা গুরুতর অন্যায়। এমনটিতেই আমাদের সমাজে অল্পতেই কলঙ্ক লেগে যায় বা লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে একটি নবজাতক শিশু যে কিনা নিষ্পাপ, তাকে জন্মের সাথে সাথেই যদি বলা হয় যে এই পৃথিবীতে সে একজন অবৈধ বাসিন্দা, এখানে তার দোষটা কোথায়?
বিবাহ বহির্ভূত বা যার সাথে আইনত বিবাহ সম্পন্ন হয়নি, এমন কারো সাথে অনৈতিক বা অবৈধ ভাবে যৌন সহবাসের ফলশ্রুতিতে যে সন্তান জন্ম লাভ করে, সে ক্ষেত্রে অনৈতিক বা অবৈধ কাজ করলো তার মা কিংবা বাবা, অথচ অবৈধ মা কিংবা অবৈধ বাবা বলার পরিবর্তে বলা হচ্ছে অবৈধ সন্তান। আমাদেরকে প্রথমত এই ভুল শব্দ চয়ন থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।
তারপর ১১২ ধারায় যে দুইটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে বা যে দুই শর্তের যেকোনো একটির ভিত্তিতে সন্তানের বৈধতা প্রমাণ করা হবে, সেই দুটো শর্ত যে আজকের দিনে বেশ অকেজো তা নিম্নে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
প্রথম শর্তটি একটু ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন যে, এখানে বাবা মায়ের বৈবাহিক সম্পর্কটিকেও বৈধ হতে হবে। কিন্তু, আইনের দুর্বলতা হচ্ছে, বৈধ বৈবাহিক সম্পর্ক বলবত থাকাবস্থায় যদি সন্তান জন্ম হয়, তাহলেই সে বৈধ সন্তান। অথচ, বৈধ বিয়ের পর জীবিকার তাগিদে যদি কেউ দূর পরবাসেও থাকে এবং সন্তান জন্ম নেয়, তাহলেও ঐ সন্তান ঐ বাবার সন্তান হিসেবে বিবেচিত হবে, যা দিয়ে আজকের দিনে বিচার করা সম্ভব নয়। স্বামী ২ বছর যাবত প্রবাসে, অথচ স্ত্রী গর্ভবতী হলেও এই আইনে ঐ স্বামীই হচ্ছে উক্ত সন্তানের পিতা, যা কিনা অসম্ভব। তাই, এই আইন এখনকার যুগে প্রায় অচল বলা চলে।
দ্বিতীয় শর্তটিও এখনকার যুগে কতটা যুগোপযোগী সেটি আসলে ভালো করে একজন ডাক্তার বুঝিয়ে বলতে পারবেন। কিন্তু, আইনি হাইপোথিসিস করে বললেও এই শর্তটিও আজকের দিনে খুব দুর্বল। কেননা, স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের ২৮০ দিনের মধ্যে যে বাচ্চা হবে সেটি অন্যের বাচ্চাও হতে পারে। কেননা, বিচ্ছেদের আগেই যদি উক্ত নারী অন্য কোন পরপুরুষের সাথে যৌন সহবাস করে থাকে এবং এরপর তালাক হয়ে থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রেও ২৮০ দিনের মধ্যে যদি সন্তান জন্ম নেয় তা সদ্য তালাক দেওয়ার স্বামীর সন্তান কিভাবে হল?
ব্রিটিশরা তখনকার সময় অনুযায়ী যে আইন বানিয়েছিল, তা আজকের দিনে ত্রুটিপূর্ণ। তাই, আজকের দিনে যতটুকু যুগোপযোগী ততটুকু রেখে বাকিটুকু সংশোধনের সময় এসে গেছে। আশা করি, যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরে পড়লে সঠিক পদক্ষেপ নিবেন। আজকে এ পর্যন্তই, ধন্যবাদ।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )