সাক্ষ্য আইন

সাক্ষ্য আইনে তৃতীয় পক্ষের অভিমত: পর্ব ০১

সাক্ষ্য আইন

আপনি একটি মামলা করেছেন বা কেউ একজন আপনার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছে, এই মামলার অর্থ কিন্তু এই নয় যে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে উক্ত অপরাধের জন্য সাজা প্রদান করা হবে। একটি মামলায় তখনি কেবল অভিযুক্ত ব্যক্তি তথা আসামীকে সাজা দেওয়া হবে যখন অভিযুক্ত ব্যক্তি বা আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। আর এই সত্যতা যাচাই করার প্রক্রিয়া হচ্ছে, ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের অধীনে অভিযোগটির সত্যতার মানদণ্ড নির্ধারণ করা। সাক্ষ্য আইন অনুসারে, প্রমাণের ভিত্তিতে দেওয়ানী মামলায় প্রমাণের ভার যে পক্ষে বেশি, মামলার রায় সেই পক্ষের দিকেই যাবে। কিন্তু, ফৌজদারি মামলায় আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করতে হবে। যদি সামান্য সন্দেহও থেকে যায় সেই ক্ষেত্রে আসামীর খালাস করে দিতে হবে।

এখন একটি মামলায় আপনি বাদী হলে আপনার দায়িত্ব হচ্ছে, আপনি আপনার সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আসামীর বিরুদ্ধে আপনার যে অভিযোগ সেই অভিযোগগুলোকে সন্দেহাতীত ভাবে আদালতের নিকট প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করবেন এবং আদালত সবকিছু যাচাই বাছাই করে আপনার আনীত অভিযোগের সত্যতা ফেলে, আসামী তথা অভিযুক্তকে সাজার ঘোষণা দিবেন। একই ভাবে আপনার বিরুদ্ধেও যদি অন্য কেউ কোন মামলা দায়ের করে, তবে সেই মামলায় আপনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বাদীকে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু, আপনি যদি আপনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করার সময় বাদীকে পরাস্ত করতে পারেন তাহলে মামলা থেকে আপনাকে খালাস করে দেওয়া হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কি বাংলা সিনেমার মত বাদী বা সাক্ষীকে আক্রমণ করে মামলা প্রমাণ করতে বাঁধাগ্রস্ত করবেন?- অবশ্যই না। আপনাকে বাদীর আনীত অভিযোগ সমূহ প্রমাণের সময় শুধু সন্দেহ তৈরি করে দিতে হবে। স্থান, কাল, পাত্র এর কোনটির মধ্যে যদি কোন সন্দেহ ঢুঁকে যায় আর বাদী সেটি সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়, তবে আদালত আপনাকে খালাস দিয়ে দিতে পারেন।

আর, এই সাক্ষ্য প্রমাণের জন্য বাদী বা বিবাদীরা সাধারণত মামলার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি বা মামলার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে অবগত বা তর্কিত ঘটনার সময় উপস্থিত ছিল এমন কাউকে মামলার সাক্ষী হিসেবে প্রস্তাব করে থাকে। মামলা উক্ত সাক্ষী সমূহ এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দালিলিক সাক্ষ্যর ভিত্তিতে মামলায় আনীত অভিযোগটি প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু, এমন কিছু বিষয় থাকে যেখানে মামলার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ দ্বারা আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করা যায় না। আর যখনি মামলার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা মামলা প্রমাণ করা সম্ভব হয় না, তখনি তৃতীয় পক্ষের অভিমতের ভিত্তিতে আদালতকে মামলার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয়। সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এর ধারা ৪৫ থেকে ৫১ পর্যন্ত ‘তৃতীয় পক্ষের অভিমত যেভাবে একটি মামলায় প্রাসঙ্গিক হবে’ সেই সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। আমরা কয়েকটি পর্বে এই তৃতীয় পক্ষের অভিমত তথা বিশেষজ্ঞের অভিমত নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করবো; যার ফলে আমরা জানতে পারব কখন আমরা আমাদের মামলায় তৃতীয় পক্ষ তথা বিশেষজ্ঞের অভিমত নিতে বা আমাদেরকে কখন বিশেষজ্ঞের অভিমত দেওয়ার জন্য আদালত তলব করতে পারে। ভালো কথা, এখানে মজা করে কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল বা ইউটিউব চ্যানেলের মত শিরোনাম / ইন্ট্রো দেওয়া যেতে পারে এমন যে, আপনি কি নিজেকে বিশেষজ্ঞ বলে মনে করেন, তাহলে আর্টিকেলটি না টেনে বা লাফিয়ে লাফিয়ে না পড়ে মনোযোগ দিয়ে শেষ পর্যন্ত পড়ুন।



যাই হোক, সাক্ষ্য আইনের ৪৫ ধারায় বিশেষজ্ঞের অভিমত কীভাবে আপনার আমার একটি মামলায় প্রাসঙ্গিক হতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা সরাসরি ধারা নিয়ে ধারাভাষ্য দিলে আগা-মাথা কিছুই না বুঝতে পারেন। তাই, আমরা উদাহরণ দিয়ে দিয়ে বিষয়টা একদম পানির মত সহজ করে বুঝবো। যদিও উপরে আমরা যেভাবে লম্বা পটভূমি টেনেছি, তাতে অনেকেই ইতিমধ্যে আঁচ করতে পেরেছেন বিশেষজ্ঞ অভিমত আসলে কি, কেন এবং কীভাবে এর প্রয়োগ করতে হবে।
ধরুন আপনার আমার কোন মামলায় আদালত,
• বিদেশী কোন আইনের প্রশ্নে বা
• বিজ্ঞান বিষয়ক কোন প্রশ্নে বা
• চারুকলা সংক্রান্ত কোন প্রশ্নে বা
• অর্পণ (হাতের লেখা) বা টিপসই শনাক্ত করার প্রশ্নে
আমাদের দুই পক্ষের সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছাতে পারছেন না, তখন আদালত বিদেশী আইনের প্রশ্নে বা বিজ্ঞান বা চারুকলা বা অর্পণ বা টিপসই শনাক্ত করার ক্ষেত্রে বিশেষ পারদর্শী কোন ব্যক্তির অভিমত গ্রহণ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আদালত যে উক্ত পারদর্শীর মতামত গ্রহণ করলেন যিনি কিনা মামলার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না, তাকেই তৃতীয় পক্ষের অভিমত বা বিশেষজ্ঞের অভিমত হিসেবে অভিহিত করা হবে।

উদাহরণ হিসেবে ৪৫ ধারায় উল্লেখিতগুলোই যথেষ্ট। যেমন, একজন মানুষকে বিষ প্রয়োগ করে খুন করা হয়েছে, এটা আপনি আমি দেখে সন্দেহাতীত ভাবে বলতে পারব না। কিন্তু, একজন বিশেষজ্ঞ বিষ প্রয়োগের ফলে যেসব লক্ষণ প্রদর্শন করে মৃত্যুবরণ করে, সেই বিষয়ে বিশেষ ভাবে অজ্ঞ হয়ে থাকেন, তাই তিনি ভিকটিমকে দেখেই বলতে পারবেন যে, আদৌ কোন বিষ প্রয়োগ করে খুন করা হয়েছে কিনা আর বিষ প্রয়োগ করা হলেও সেটি কোন ধরনের বিষ।

একটি দলিল কে লিখেছে বা দলিলে একটি স্বাক্ষর কে করেছে, এই বিষয়গুলো বুঝবেন কেবল যারা অর্পণ (হাতের লেখা) বা টিপসই শনাক্ত করতে পারদর্শী। তাছাড়া, একজন মানুষ কখন মানসিক ভাবে বিকৃত, বিকৃত হলেও কখন কোন কাজের প্রকৃতি বুঝতে অক্ষম বা অপারগ বা বিকৃত হওয়া সত্ত্বেও ঐ মুহূর্তে তার কাজকে যে অপরাধ সেটা বুঝতে সে সক্ষম কিনা ইত্যাদি বিষয়াদি আমি, আপনি বা স্বয়ং মহামান্য আদালতও সবসময় সঠিক ভাবে বুঝতে সক্ষম নন। তাই, কেবলমাত্র যারা এই সব বিষয়ে পারদর্শী এবং বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, তাদেরকেই বিশেষজ্ঞের অভিমত দেওয়ার জন্য আদালত যেকোনো মামলায় তলব করতে পারেন। এই ক্ষেত্রে ওনাদেরকে উক্ত মামলার সাথে কোনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.