সাক্ষ্য আইন

সাক্ষ্য হিসেবে আদালতে যেসব চরিত্র প্রাসঙ্গিক

সাক্ষ্য আইন

একবার এক লোক চারিত্রিক সনদের জন্য গিয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে। অফিসে গিয়ে শুনল, চারিত্রিক সনদের জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কারণ জানতে চাইলে প্রথমে কোন উত্তর পাওয়া না গেলেও কিছুক্ষণ খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে যে, চেয়ারম্যান সাহেব দুশ্চরিত্রের অভিযোগে এক মাসের জন্য কারাগারে আছেন। চেয়ারম্যান কারাগার থেকে মুক্তি পেলে তারপর চারিত্রিক সনদ পাওয়া সম্ভব। যার দুশ্চরিত্রের জন্য কারাদণ্ড হয়, সে যদি চারিত্রিক সনদ দেয়, তাহলে বুঝেন এই সনদের মূল্য কতখানি? এই সনদ গুলো আসলে কোন কাজে লাগে কিনা কে জানি। কাউকে আজ পর্যন্ত চারিত্রিক সনদে দুশ্চরিত্রা বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে কিনা সেটা আমার অজানা। এই সনদ সিস্টেম অকেজো হলেও আমাদের বিচার ব্যবস্থায় কিন্তু চরিত্র এবং দুশ্চরিত্র উভয়ই প্রাসঙ্গিক। তবে, সেটা অবশ্যই পরিস্থিতি ভেদে।
আগে আসুন চরিত্র সম্বন্ধে জানি। চরিত্র কাকে বলে? আমরা একজন মানুষের স্বভাব চরিত্র ভালো খারাপ বলে থাকি কিন্তু চরিত্র বলতে আসলে বুঝায়, ‘খ্যাতি এবং প্রকৃতি’। একটি মামলায় যখন কোন ব্যক্তির ইন্টেনশন বুঝতে গেলে তার চরিত্র বুঝতে হয়, আর চরিত্র বুঝতে গেলে আসামীর খ্যাতি এবং প্রকৃত বুঝতে হবে।

ফৌজদারি মামলায় একটা মজার বিষয় হচ্ছে, সাক্ষ্য আইনের ৫৩ ধারা অনুসারে, আসামীর চরিত্র যে উত্তম তা প্রাসঙ্গিক বিষয় হলেও ৫৪ ধারা অনুসারে আসামীর চরিত্র যে খারাপ তা প্রাসঙ্গিক বিষয় নয়। কিন্তু, এখানেও ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, আপনার চরিত্র ভালো এই মর্মে যদি সাক্ষ্য প্রদান করা হয়, তাহলে চরিত্র মন্দ বা খারাপ এটা তখন প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। অর্থাৎ, এমনিতে খারাপ চরিত্র বা মন্দ চরিত্র প্রাসঙ্গিক হয় না, কিন্তু যখনি কেউ নিজের চরিত্র ভালো এটাকে সাক্ষ্য হিসেবে নিয়ে আসে বা কারো চরিত্র ভালো এই মর্মে সাক্ষ্য প্রদান করা হয়, তখন ঐ লোকের চরিত্র যে খারাপ তা তখন বলা যাবে বা আদালতে সেই বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু উপস্থাপন করা যাবে। বিষয়টা ক্লিয়ার করতে একটু ব্যাখ্যায় যেতে হবে।

আপনি আর আমি একটি মামলার বাদী এবং বিবাদী। আপনি ধরুন বাদী আর আমি বিবাদী তথা আসামী। এখন আমরা উভয়েই মামলার বিষয়বস্তু নিয়েই জবানবন্দী দিচ্ছি, জেরা করা হচ্ছে এরপর পুনরায় জবানবন্দী নেওয়া হচ্ছে। কোথাও আমরা চরিত্র নিয়ে কোন প্রশ্ন উত্তাপন করি নি। আপনিও করেননি, আমিও করিনি। এখন মামলার বিষয়বস্তুটা এমন যে, মামলায় নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে হলে হয় আমি আপনার চরিত্র খারাপ করতে হবে, নয়ত আপনি আমার চরিত্র খারাপ করতে হবে। চরিত্র খারাপ বলতে চরিত্র খারাপ স্বরূপ প্রাসঙ্গিক কিছু সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। এখন, কে প্রথমে কার চরিত্র খারাপ এই বলে উপস্থাপন করবে?



এখানে সাক্ষ্য আইনের ৫৪ ধারার দিকে খেয়াল করেন, তাহলে দেখবেন যে, স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, ফৌজদারি মামলায় আসামীর চরিত্র যে খারাপ, এটা প্রাসঙ্গিক বিষয় নয়। অর্থাৎ, আপনি প্রথমে আমাকে আমার চরিত্র খারাপ এটা দাবি করে কোন কিছু উপস্থাপন করতে পারবেন না। এই বিষয়টা আপনার জন্য একেবারে আইনবলে বাঁধাগ্রস্ত। কিন্তু, নিজের পায়ে কুড়ল মারা বলতে যেটা বুঝায়, সেটা হচ্ছে যদি আমি নিজের চরিত্র ভালো বলে দাবি করি। এই জায়গায় অনেকেই ভুল করে থাকে। যেখানে আমার প্রতিপক্ষ চরিত্র খারাপ দাবি করে প্রাসঙ্গিক কিছু উপস্থাপন করতে পারছে না, যার মানে দাঁড়াচ্ছে যে, আমার চরিত্র ভালো না হলেও খারাপ না। যেহেতু চরিত্র নিয়ে কোন কথা উঠেনি, বিশেষ করে খারাপ চরিত্র প্রমাণ স্বরূপ প্রাসঙ্গিক কিছুই উপস্থাপন করা হয়নি, সেহেতু আপাত দৃষ্টিতে চরিত্র ঠিকঠাক। আর আমি মুখ খোলার আগ পর্যন্ত আমার চরিত্র নিয়ে আপনি বাদীর কিছুই বলার নেই। আপনি আমার চরিত্র নিয়ে কিছু বললেও সাক্ষ্য আইনের ৫৪ ধারা দ্বারা সেটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। এখন আমি সাক্ষ্য আইনের ৫৩ ধারা অনুযায়ী যেহেতু অপরাধী ব্যক্তির চরিত্র যে উত্তম, তা প্রাসঙ্গিক; আর আমিও অতি উৎসাহী হয়ে নিজের চরিত্র যে উত্তম সেটি প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লাগছি। তখনি ৫৪ ধারায় আপনার জন্য সুযোগ খুলে যাবে। আপনি তখনি আমার বিরুদ্ধে আমার চরিত্র যে খারাপ সেটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে; অর্থাৎ আপনি আমার চরিত্র খারাপ প্রমাণ করতে যে কোনো কিছুই উপস্থাপন করতে পারবেন। যেমন, পূর্বের কোন মামলায় যদি আমার দুশ্চরিত্রের বিষয়টি প্রমাণিত হয় তখন সেটি চলমান মামলায় প্রাসঙ্গিক হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে। সাক্ষ্য আইনের ৫৪ ধারার ব্যাখ্যা-২ এ বলা হয়েছে যে, সাক্ষ্য হিসাবে খারাপ চরিত্রে পূর্ববর্তী দণ্ডাদেশ প্রাসঙ্গিক। যদি কোন ব্যক্তি ইভ টিজিং এর মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়, তাহলে পরবর্তীতে যদি কোন মামলায় ঐ দোষী ব্যক্তির যদি ৫৪ ধারায় নিজেকে উত্তম চরিত্রবান দাবী করে তবে সেই ক্ষেত্রে পূর্বের ইভ টিজিং এর মামলার রায় ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রাসঙ্গিক হবে।

এখানে আরেক উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, সাক্ষ্য আইনের ৫২ ধারায় কিন্তু দেওয়ানী মামলায় চরিত্র অপ্রাসঙ্গিক। স্বাভাবিক আপনার সাথে আমার জমিজমা নিয়ে মামলা হচ্ছে, সেখানে আপনার চরিত্রের সাথে না আছে জমির সম্পর্ক না আছে আমার চরিত্রের সাথে। তবে যদি অন্য কোন ভাবে প্রাসঙ্গিক ঘটনা থেকে চরিত্র যতটা প্রকাশিত হয়, ততটা প্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে ক্ষতিপূরণের মামলায় যদি চরিত্র ভালো খারাপ হওয়াটা প্রভাবিত করে, তবে দেওয়ানী মামলায় চরিত্র প্রাসঙ্গিক হবে।

যেহেতু একান্ত আদালতের কার্যবিধির বিষয়, সেহেতু একটু জটিল তবে ভবিষ্যতে আরও সহজতর করার চেষ্টা করবো।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.