বাজার থেকে আমরা পণ্য কেনার সময় পণ্যের মোড়কে তার মূল্য যেমন যাচাই করে থাকি, তেমনি পণ্যটির মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখও পরোখ করে দেখি। কোন কোন পণ্যের গায়ে মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ লেখা থাকে না; এর পরিবর্তে পণ্যের উৎপাদনের তারিখ লেখা থাকে এবং উৎপাদন তারিখ থেকে কতদিন উক্ত পণ্যের মেয়াদ থাকবে সেটাও উল্লেখ করে দেওয়া হয়। যেমন, আজকের তারিখ উল্লেখ করে, এরপর পণ্যটি কয়দিন বা কয় মাসের জন্য মেয়াদ প্রাপ্ত তা উল্লেখ করে দেয়া হয়। কোন পণ্যের গায়ে যদি ৭ দিন মেয়াদ উল্লেখ করা থাকে, তবে উৎপাদনের তারিখ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ঐ পণ্যটি আপনাকে ব্যবহার করতে হবে। মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি করাই অন্যায়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুসারে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।বিক্রেতা পণ্যটি নিজে উৎপাদন করুক বা খুচরা বা পাইকারি বিক্রেতা হিসেবে বিক্রি করুক না কেন, যদি মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে থাকে, তবে আপনি আমি কোন মতেই সেই পণ্য ক্রয় করবো না। এমনকি ফ্রিতে দেওয়া হলেও আমরা মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য ক্রয় করবো না। কেননা, মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য যদি খাবার জাতীয় কিছু হয়ে থাকে, তবে সেই খাবার খাওয়ার পর তা শারীরিক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর যদি অন্য কোন ধরণের পণ্য হয়ে থাকে সেটিও মেয়াদ উত্তীর্ণের কারণে যে কাজে ব্যবহার করা হবে, সেই কাজের ‘উদ্ধার’ করে ছাড়বে।
মেয়াদ উত্তীর্ণের পর পণ্য যেমন ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ে তেমনি মামলা করার জন্যও একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা তামাদি আইন ১৯০৮ এ স্পষ্ট সময় নির্ধারণ করে কিছু ব্যতিক্রম সহ উল্লেখ করা হয়েছে। বিক্রেতা বা উৎপাদনকারী যেমন নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে পণ্য বিক্রয় করতে না পারলে, উক্ত পণ্য ক্রেতা গ্রহণ করবে না; বিক্রেতার লোকসান গুনতে হলেও না। তেমনি, বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যও যদি কেউ মেয়াদ বা তামাদির পর মামলা দায়ের করে, তবে তা বৈধ অধিকার হওয়া স্বত্বেও আদালত তা খারিজ করে দিবে।
তামাদি মেয়াদ বলতে একটি মামলা করার জন্য যে নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে যার মধ্যে মামলা করতে হবে, তা বুঝানো হয়ে থাকে। উক্ত সময় পার হওয়ার পর যদি কোন পক্ষ কোন মামলা দায়ের করে, আর বিবাদী পক্ষ সেটা খেয়াল না করে বা আদালতের কাছে মামলার তামাদির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে মর্মে বিবাদী পক্ষ কিছু না জানালেও আদালত উক্ত মামলা খারিজ করে দিবে। উল্লেখ্য, শুধু মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে তামাদির মেয়াদ গণনা হবে, তা কিন্তু নয়। তামাদি আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী, মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর মামলা, আপীল বা দরখাস্ত রুজ, দায়ের বা দাখিল করা হলে তা খারিজ বলে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ, আইনবলে স্পষ্ট এই যে, তামাদির মেয়াদ শেষ হলে আর মামলা, আপীল, দরখাস্ত দায়ের করা যাবে না।
এখন আসুন বিদ্যুৎ বিল নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। যদিও এখন প্রি-পেইড (অর্থাৎ, টাকা ঢুকিয়ে যে মিটার সচল রাখা হয়) মিটারের যুগ চলছে, তারপরও গ্রামে এখনো অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ বিল পোস্ট পেইড সিস্টেম রয়ে গেছে। অর্থাৎ, মাস শেষে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়েছে, তার ইউনিট হিসেব করে বিদ্যুৎ বিল প্রস্তুত করা হয় এবং গ্রাহকের বাসায় বিলের কাগজ পৌঁছে দেওয়া হয়, যেখানে বিল পরিশোধের শেষ তারিখ উল্লেখ করা থাকে। বিল পরিশোধের এই শেষ তারিখের পরও বিল পরিশোধ করা না হলে জরিমানা প্রদান করতে হয় আর বেশী টাকা জমে গেলে কখনো কখনো সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। যাই হোক, জরিমানা বা সংযোগ বিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ বিলের বেলায় যতটা সহজতর, মামলার ক্ষেত্রে সংযোগ বিচ্ছিন্ন বলে কিছু নাই। মামলা দায়ের করতে না পারার অধিকারকে ও অনেকটা অধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মত বলা যেতে পারে। কিন্তু, বিদ্যুৎ বিলের একটা বিষয়ের সাথে মামলার তামাদির মেয়াদের একটা স্পষ্ট মিল রয়েছে, তা হচ্ছে বিল পরিশোধের শেষ তারিখে যদি ব্যাংক ব্য বিদ্যুৎ অফিস খুলবে সেই দিনই শেষ তারিখ হিসেবে ধরে নিয়ে বিল পরিশোধ করতে হবে। সাধারণত, শুক্রবার, শনিবার বা সরকারী কোন ছুটির দিন যদি এমন শেষ তারিখে পড়ে থাকে, তখন পুনরায় খোলার দিনই বিল পরিশোধ করতে হয়। ঠিক তেমনি আপনি কোন মামলা বা আপীল বা দরখাস্ত দায়ের করার শেষ তারিখে যদি আদালত বন্ধ থাকে তাহলে তামাদি আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী আদালত বা দরখাস্ত দায়ের করতে হবে। অন্যথায় মামলা বা আপীল বা দরখাস্ত খারিজ বলে বিবেচিত হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, তামাদির মেয়াদ দেওয়ানী মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেননা ফৌজদারি মামলার দায়েরের ক্ষেত্রে কোন তামাদির মেয়াদ নেই। ৫০ বছর আগের কৃত কোন ফৌজদারি অপরাধের জন্য মামলা আজকের দিনেও দায়ের করা যাবে। কিন্তু, দেওয়ানী মামলার ক্ষেত্রে অধিকার ভেদে সময় বেঁধে দেওয়া আছে। উক্ত সময়সীমার মধ্যে মামলা দায়ের না করলে তা খারিজ হয়ে যাবে। তবে, ফৌজদারি তথা ক্রিমিনাল মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে তামাদি মেয়াদ অনুসরণ করতে হবে। আপীলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আপীল দায়ের করলে আপীল গ্রহণযোগ্য হবে না। অর্থাৎ, ফৌজদারি মামলা দায়েরে তামাদি নেই, তবে রায়ের পরবর্তী পদক্ষেপে তামাদি অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু, দেওয়ানী মামলার ক্ষেত্রে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তামাদি আইন অনুসরণ করতে হবে।
চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএল.বি) ও স্নাকোত্তর (এলএল.এম) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি আইন বিষয়ে লেখালেখি চর্চা করে আসছেন।
( এই আর্টিকেলটি নিয়ে আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে, যোগাযোগ করুনঃ 01882-689299, ই-মেইল: tanbiradvocate@gmail.com )