জামিন কি অপরাধীর আশ্রয় নাকি ন্যায়বিচারের হাতিয়ার?

ফৌজদারি আইন

আইন পেশায় প্রথমে একজন আইনের ছাত্র, তারপর শিক্ষানবিশ আইনজীবী এবং সবশেষে একজন প্র্যাকটিসিং আইনজীবী হিসেবে আমার পথচলায় দেশের বিভিন্ন আদালতে জামিনসংক্রান্ত অসংখ্য মামলা থেকে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে শেখার এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ হয়েছে। কখনো নিজ ক্লায়েন্টের পক্ষে জামিন করিয়েছি, আবার কখনো সিনিয়র আইনজীবী ও সহকর্মীদের জামিন শুনানিতে অংশ নিয়ে তাঁদের দক্ষতা ও কৌশল দেখে শিখেছি—কীভাবে একটি জামিন আবেদন আরও কার্যকরভাবে উপস্থাপন করা যায় এবং কীভাবে নিজের ক্লায়েন্টের জামিন নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টা চালানো যায়।

আমি বিশ্বাস করি, একজন দক্ষ আইনজীবী হতে হলে নিজের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা নেওয়া জরুরি। তখনই কেবল নিজের ক্লায়েন্টকে জামিনসহ অন্যান্য আইনি প্রতিকারে সহায়তা প্রদান করে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব। এই উপলব্ধি থেকেই আমি জামিনসংক্রান্ত যাবতীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি ধারাবাহিক লেখার পরিকল্পনা করেছি, যেখানে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, পুঁথিগত বিদ্যা এবং জামিনের আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে আমার বিশ্লেষণ তুলে ধরার চেষ্টা করব।

পুঁথিগত বিদ্যা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে আমি উপলব্ধি করেছি, জামিন কেবল একটি আইনি প্রক্রিয়া নয়; এটি একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারের প্রতি রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতির প্রতীক। আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থায় জামিনকে যদি শুধুমাত্র একটি সুবিধা হিসেবে দেখা হয়, তবে এর প্রকৃত গুরুত্ব খাটো করা হয়। জামিন আমাদের বিচারব্যবস্থার একটি মৌলিক স্তম্ভ।

কারণ, একজন নিরপরাধ ব্যক্তি যদি মিথ্যা মামলায় বা ভুলবশত অভিযুক্ত হয়ে গ্রেপ্তার হন এবং কারাগারে আটক থাকেন, তাহলে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের রাষ্ট্র ও বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা ভেঙে যায়। অথচ, যদি জামিনের মাধ্যমে তাঁকে একটি নিরপেক্ষ অবস্থানে ফিরিয়ে আনা যায়, তবে তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন। এতে বিচারব্যবস্থার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা যেমন অটুট থাকবে, তেমনি তিনি ব্যক্তিগত ও পেশাগত বিপর্যয় থেকেও রেহাই পাবেন।

জামিনসংক্রান্ত আলোচনা কেবল তাত্ত্বিক না রেখে, চলুন কিছু বাস্তব কেস স্টাডির মাধ্যমে বিষয়টি আরও পরিষ্কারভাবে বোঝার চেষ্টা করি।

৫ ডিএলআর (এসসি) ১৫০ এই মামলার রায়ে বলা হয়েছে: “জামিন হল পুলিশের হেফাজত থেকে কোনো ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়া এবং তাকে জামিনদারের হাতে সোপর্দ করা, যিনি প্রয়োজনে তাঁকে আদালতে হাজির করবেন—এই মর্মে অঙ্গীকার করেন।”

এটি জামিনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ব্যাখ্যা করে:

  • রাষ্ট্রের হেফাজত থেকে সাময়িক মুক্তি
  • আদালতে নির্ধারিত সময়ে হাজিরার নিশ্চয়তা

উদাহরণস্বরূপ:
রাকিব নামের এক যুবককে পুলিশ একটি বাগানবাড়ি থেকে সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার করে, যেখানে একটি চুরির ঘটনা ঘটেছিল। রাকিব ঘটনাস্থলে থাকলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো সরাসরি সাক্ষ্য বা আলামত ছিল না। আইনজীবী ৫ ডিএলআর (এসসি) ১৫০ রেফার করে জামিন আবেদন করেন এবং আদালত তাঁকে পরিবারের জিম্মায় জামিনে মুক্তি দেন।

এখান থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, রাকিব বা আপনি-আমি যদি কোনো মামলায় কোনোভাবে অভিযুক্ত হয়ে যাই, তখন যদি গ্রেফতার হই, তাহলে আমরা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগের পরিবর্তে উল্টো অন্যায়ভাবে জেল খাটতে হবে এবং আর্থিক, সামাজিক, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে হবে। কিন্তু, যদি গ্রেফতার এড়িয়ে জামিন পাওয়া যায়, তাহলে সবকিছু ঠিক রেখে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা চালানো যেত।

১৩ বিএলডি ১২৩ এই মামলার রায়ে বলা হয়েছে: “জামিনের বিষয়টিকে শাস্তি হিসেবে ধরে রাখা ঠিক নয়।”

প্রাসঙ্গিক কাহিনি:
মেহজাবিন, একজন স্কুল শিক্ষিকা, স্কুলের তহবিল তছরুপের অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তদন্ত চলাকালীন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, রিমান্ডে নেওয়া হয় এবং বারবার জামিন আবেদন করলেও তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। শেষমেশ তাঁর আইনজীবী আদালতে ১৩ বিএলডি ১২৩ রেফার করে বলেন, “জামিন না দেওয়ার মাধ্যমে তাঁকে একটি অপ্রমাণিত অপরাধের জন্য শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।”

২৫ ডিএলআর ৩৩৫ এই মামলার রায়ে বলা হয়েছে: “পাঁচ মাস তদন্তের পরেও যদি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ না পাওয়া যায়, তবে তাঁকে আটক রাখা আদালতের অপব্যবহার।”

ঘটনা:
সুমন নামের এক যুবককে বিস্ফোরণের মামলায় “সন্দেহভাজন” হিসেবে গ্রেফতার করা হয়। পাঁচ মাস তদন্ত চললেও কোনো দৃশ্যমান প্রমাণ মেলেনি। অথচ সুমন ছিলেন কারাবন্দি—তাঁর চাকরি, পরিবার, সামাজিক সম্মান সবকিছু হারিয়ে গেছে। এতে তার জীবন থেকে যেমন মূল্যবান সময় চলে যাচ্ছে, তেমনি চলে গেছে তার চাকরি, তার প্রিয়তমা স্ত্রী এবং সামাজিক মূল্যবোধ। শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ক্ষতি হিসেবে যা হিসাব করা যায় না, তেমন অনেক কিছুই হারিয়েছেন তিনি।

 

জামিন কোনোভাবেই অপরাধীকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নয়। যতক্ষণ না আদালত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে, ততক্ষণ তিনি আইনের চোখে নির্দোষ। একজন অভিযুক্ত যাতে বিচার চলাকালীন তাঁর স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করাই জামিনের মূল লক্ষ্য।

৫ ডিএলআর (এসসি) ১৫০, ১৩ বিএলডি ১২৩ এবং ২৫ ডিএলআর ৩৩৫—এই রায়গুলো কেবল আইনজীবীদের জন্য নয়, বিচারকদের জন্যও দিকনির্দেশনামূলক। এদের আলোকে আমরা এমন একটি মানবিক বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি, যেখানে কেউ বিনা বিচারে কষ্ট না পায়।

আমাদের সমাজে মিথ্যা মামলা করার প্রবণতা ব্যাপক, বিশেষ করে নারী নির্যাতনের মামলাগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তদন্তের পরে প্রমাণিত হয় না। অথচ এইসব মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তিকে জামিন না দিয়ে গ্রেফতার করলে, তাঁর জীবনের কত কিছু যে ছিনিয়ে নেওয়া হয়, তা কেবল সেই ব্যক্তি এবং তাঁর পরিবারই জানে।

একজন আইনজীবী হিসেবে আমি সবসময় ন্যায়বিচারের পক্ষে থাকার চেষ্টা করি—হোক সেটা আদালতে, কোনো সালিশে বা আমার কলমের মাধ্যমে।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.