আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার

হুলিয়া, ক্রোক, অতঃপর ফেরারী আসামি হওয়ার প্রক্রিয়া

ফৌজদারি আইন

একজন আসামি ধরুন আপনি, আপনার বিরুদ্ধে যদি একটি ফৌজদারি মামলা করা হয় অর্থাৎ ক্রিমিনাল মামলা দায়ের করা হয় এবং সেটি আপনি জানেন যে আপনি উক্ত অপরাধ প্রকৃতই করেছেন বা আপনি অপরাধী নন, আপনার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে, যেভাবেই আপনি আসামি হয়ে থাকুন না কেন, আপনার বিরুদ্ধে যদি কোন মামলা দায়ের করা হয়ে থাকে, সেই ক্ষেত্রে আপনার একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে মামলাটি মোকাবেলা করা।

সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে, আপনার বিরুদ্ধে কোন মামলা যদি হয়ে থাকে সেই ক্ষেত্রে সেটি যদি দেওয়ানি মামলা হয়ে থাকে এবং আপনি যদি আদালতে উপস্থিত না হয়ে থাকেন, সেই ক্ষেত্রে আপনার বিরুদ্ধে বাদি যে মামলা বা অভিযোগ করেছে সেটি আপনি বিবাদী অনুপস্থিত থাকার কারণে আদালত বাদীর পক্ষে একতরফা রায় ঘোষণা করবেন। অতএব আদালতে হাজির না হয়ে আপনি নিজের পায়েই নিজে কুড়াল মারলেন। ঠিক একই ভাবে আপনি যদি কোন ক্রিমিনাল মামলায় অভিযুক্ত হয়ে থাকেন অর্থাৎ আসামি হয়ে থাকেন, সেই ক্ষেত্রে আপনার প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে মামলায় উপস্থিত থাকা এবং আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো দায়ের করা হয়েছে সেই অভিযোগগুলোর বিপরীতে নিজের পক্ষে তথা আত্মপক্ষ সমর্থনে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে যুক্তি খণ্ডন করা, যার ফলে আপনি মামলা হতে বেকসুর খালাস প্রাপ্ত হতে পারেন।কিন্তু আপনি যদি মামলার ভয়ে আদালতে উপস্থিত না হয়ে আত্মগোপনে থাকার চেষ্টা করেন, সেই ক্ষেত্রে আপনি নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনবেন। কেননা ফৌজদারি মামলাতে যদি আপনাকে অভিযুক্ত বা আসামি করা হয় এবং আপনি যদি আদালতের ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকেন অর্থাৎ আইনের ভাষায় যাকে বলা হয়ে থাকে, আসামীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি সেই আসামি গ্রেফতার এড়ানোর জন্য পালিয়ে থাকেন অথবা অন্য যেকোনো ভাবে আদালতে উপস্থিত না হয়ে থাকেন, সেই ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৮৭ ধারা অনুসারে উনার বিরুদ্ধে হুলিয়ে জারি করা হবে এবং তারই পরবর্তী ধারা অর্থাৎ ৮৮ ধারা অনুসারে আসামির বিরুদ্ধে সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ প্রদান করা হবে। এবার আসুন দেখি হুলিয়া কাকে বলে?

 

হুলিয়াঃ কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি পরোয়ানা জারি করে হয় কিন্তু সেই ব্যক্তি পলাতক থাকে বা আত্মগোপনে থাকে, সেই ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে আদালতে উপস্থিত করানোর জন্য আদালত হুরিয়ে জারি করে থাকেন। হুলিয়াতে সময় উল্লেখ থাকে, সেই সময় বা হুলিয়া জারির তারিখ হতে অন্তত ৩০ দিন সময় দিয়ে আদালত উক্ত আসামীকে উপস্থিত হওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করবেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আসামি যেহেতু পলাতক, সেহেতু হুলিয়াটা কোথায় জারি করা হবে?
হুলিয়া সাধারণত যে ব্যক্তির উদ্দেশ্যে জারি করা হচ্ছে অর্থাৎ ওই পলাতক আসামি যেখানে বসবাস করে সেখানে হুলিয়া জারি করা হয়। যেমন তার বাড়ির সামনে, তার ঘরের সামনে বা যে শহরে/গ্রামে যেখানে বসবাস করে সেখানে যে স্থান থেকে উক্ত হুলিয়াটি সকলে দেখতে পারবে এমন কোন স্থানে সেই হুলিয়াটি ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। তাছাড়া উক্ত হুলিয়ার একটি কপি আদালত ভবনের প্রকাশ্য স্থানে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।

এখন কথা হচ্ছে, উক্ত হুলিয়া জারি করার পরও যদি আসামি উপস্থিত না হয়, আদালতে সে ক্ষেত্রে ওই পলাতক আসামির বিরুদ্ধে আদালতের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে?
যেহেতু ফৌজদারি কার্যবিধির ৮৭ ধারা অনুসারে হুলিয়া জারি করার পরও আসামি আদালতে উপস্থিত হয়নি, তখন ৮৮ ধারা অনুসারে হুলিয়া জারিকারী আদালত যেকোনো সময়ে উক্ত ব্যক্তির স্থাবর বা অস্থাবর বা উভয় প্রকার সম্পত্তির ক্রোক আদেশ দিতে পারেন।
মজার প্রশ্ন হচ্ছে, যদি আপনার দেশের বাড়ি ঢাকার বাহিরে ধরুন ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে থাকে, আর আপনার বিরুদ্ধে মামলাটি ঢাকায় চলমান থাকে, সেই ক্ষেত্রে ঢাকার আদালত কি আপনার দেশের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার থাকা সম্পত্তি ক্রোক করতে পারবে? উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁফৌজদারি কার্যবিধির ৮৮(২) ধারা অনুসারে, হুলিয়া জারিকারী আদালতের স্থানীয় এলাকার মধ্যে উক্ত আসামির সম্পত্তি না থেকে থাকে সেক্ষেত্রেও কোনও সমস্যা নেই। উক্ত আসামির সম্পত্তি যে এলাকায় রয়েছে সেই এলাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের পৃষ্ঠাংনে নিয়ে আসামির সম্পত্তি ক্রোক করা যাবে।

 

ফৌজদারি কার্যবিধির ৮৭ এবং ৮৮ ধারা কার্যকর করার পরেও যদি আসামি উপস্থিত না হয় এবং আদালতের এই মর্মে বিশ্বাস জন্মায় যে, আসামীকে যাতে গ্রেফতার করা না যায় বা তাঁর বিচার শুরু করা না যায়, সেজন্য সে ফেরারি হয়ে গেছে বা একেবারে আত্মগোপনে চলে গেছে, সেক্ষেত্রে তাঁকে গ্রেফতার করার যদি কোনও সম্ভাবনা না থাকে, তখন উক্ত নালিশি আদালত বহুল প্রচারিত কমপক্ষে দুই (২) টি বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত আদেশ দ্বারা উক্ত ব্যক্তিকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিবেন। কিন্তু এর পরেও যদি ওই ব্যক্তি আদালতে হাজির না হয়, সেই ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে অর্থাৎ ফেরারী আসামির অনুপস্থিতিতেই ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৯খ ধারা অনুযায়ী, তাঁর বিচার কার্য পরিচালনা করা যাবে। তবে, এখানে উল্লেখ্য যে, আসামিকে হাজির করা/ হাজির হওয়ার পর অথবা জামিনে মুক্ত হওয়ার পর যদি আসামী পলায়ন করে বা আসামী হাজির হতে ব্যর্থ হয় সেই ক্ষেত্রে উপরে উল্লেখিত বিধান ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। তবে আসামী যদি হাজির হওয়ার পর বা জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর পলায়ন করে সেই ক্ষেত্রে আদালত উপযুক্ত কারণ লিপিবদ্ধ করে তারপর তার যদি অনুপস্থিতিতে আদালত বিচার কার্য পরিচালনা করতে পারবেন।

এই হল, আদালতে হাজির না হলে হুলিয়া জারি, ক্রোক এবং সবশেষে ফেরারির আসামীর অনুপস্থিতিতে মামলার বিচারকার্যের বিধিবিধান। একটা গল্প দিয়ে শেষ করি, উট পাখিকে যখন কেউ তাড়া করে, তখন উট পাখি গিয়ে তার মাথা বালির মধ্যে ঢুকিয়ে পেলে, যার ফলে উট পাখি আর কাউকে দেখতে পায় না, তখন তার ধারনা/বিশ্বাস জন্মায় যে, সে যেহেতু কাউকে দেখছে না, তাকেও কেউ দেখছে না। আদতে উট পাখিকে বাকিরা দেখবে কি দেখবে না, সেটা আপনি আমি ভালো করেই জানি। ঠিক তেমনি, মামলা থেকে পালিয়ে বেড়িয়ে কখনো রেহাই পাওয়া যায় না; মামলা তার আপন গতিতে ঠিকই চলবে।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.