সরকারের সমালোচনা কখন রাষ্ট্রদ্রোহিতায় রূপ নিতে পারে

বিবিধ আইন

The Penal Code, 1860 এর অধীনে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা সেডিশন (Sedition) বিষয়টি রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ১২৪ক’তে বিদ্রোহী কর্মকাণ্ডের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান করা হয়েছে। দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ১২৪ক-তে বলা হয়েছে, যদি কেউ কথায়, লিখিতভাবে, ইঙ্গিত দিয়ে, দৃশ্যমান উপস্থাপনা বা অন্য কোনো উপায়ে সরকার বিরোধী ঘৃণা বা বিরাগ সৃষ্টি করেন বা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন, তবে সেটি রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা সেডিশন (Sedition) হিসেবে গণ্য হবে। এই অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা তার চেয়ে কম সময়ের কারাদণ্ড, যা ৩ বছরের বেশি হতে পারে। পাশাপাশি জরিমানা, যা কারাদণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। তবে, শুধুমাত্র জরিমানা দিয়েও শাস্তি হতে পারে।

দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ১২৪ক-তে “disaffection” শব্দটির অর্থ স্পষ্ট করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে যে, “disaffection” বলতে বোঝায় ‘রাষ্ট্রের প্রতি অসন্তোষ, অবিশ্বাস এবং শত্রুতা’। অর্থাৎ, যে কোনো ধরনের অপছন্দ বা শত্রুতা যা সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বিরাগ সৃষ্টি করে তা disaffection হিসেবে বিবেচিত হবে।

দণ্ডবিধির ধারা ১২৪ক-এর আওতায় অপরাধের উপাদানসমূহঃ

সরকারের প্রতি ঘৃণা বা বিরাগ সৃষ্টি করাঃ কোনো ব্যক্তি যদি সরকারকে অপমানিত করে বা সরকার বিরোধী অনুভূতি সৃষ্টি করে, তবে সেটি রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা সেডিশন (Sedition)। 

সরকারকে অবজ্ঞা করাঃ সরকারকে অসম্মান করা বা অবহেলা করে জনসাধারণের মধ্যে সরকারের প্রতি বিরাগ সৃষ্টি করার চেষ্টা করা।

রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা সেডিশন (Sedition) হতে পারে যেকোনো উপায়ে। এটি লিখিতভাবে, কথায়, বা দৃশ্যমান কোনো উপস্থাপনার মাধ্যমে হতে পারে।

তবে, এই ধারার কিছু ব্যতিক্রমও রেখেছে। কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকারের সমালোচনা করা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। যেমনঃ 

আইনি উপায়ে পরিবর্তনের আহ্বানঃ যদি কেউ সরকারের কোনো পদক্ষেপের সমালোচনা করেন এবং সেই পদক্ষেপ পরিবর্তনের আহ্বান জানান, কিন্তু ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি না করেন, তা সেডিশন হবে না।

প্রশাসনিক সমালোচনাঃ যদি কেউ সরকারের প্রশাসনিক কাজের সমালোচনা করেন, তবে তা সেডিশনের আওতায় পড়বে না, যদি সেই সমালোচনায় ঘৃণা বা বিরাগ সৃষ্টি না হয়।

উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো ব্যক্তি জনসম্মুখে বলেন, ‘এই সরকার দেশের ক্ষতি করছে, আমরা সবাই এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করব’, তাহলে সেটি রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা সেডিশন (Sedition) এর আওতায় আসবে, কারণ এটি সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং ঘৃণা উসকে দিচ্ছে। কিন্তু, যদি কেউ বলেন, ‘সরকারের এই সিদ্ধান্তটি সঠিক নয়, আমরা চাই এটি আইনিভাবে পরিবর্তন করা হোক’ এবং এর মাধ্যমে কোনো ঘৃণা বা বিদ্বেষ না ছড়ায়, তাহলে এটি রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা সেডিশন (Sedition) এর আওতায় আসবে না।

একজন আইনজীবী হিসেবে আপনি তথা নাগরিকদের প্রতি আমার কিছু দিক নির্দেশনাঃ নাগরিকদের রাষ্ট্রদ্রোহিতা থেকে বিরত থেকে সরকারের সমালোচনা করার এবং গঠনমূলকভাবে মত প্রকাশের জন্য কিছু দিক নির্দেশনা দেওয়া হলোঃ 

১। যুক্তিনির্ভর সমালোচনা করুনঃ সরকারের কোনো নীতি বা সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে হলে যুক্তি, তথ্য ও পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে সমালোচনা করুন। যুক্তিনির্ভর আলোচনা মত প্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষা করে এবং সরকারকেও গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে।

২। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুনঃ আপনার বক্তব্য বা মতামত প্রকাশের সময় আইনের সীমা লঙ্ঘন করবেন না। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শত্রুতা ছড়ানো নয়, বরং সমালোচনার মাধ্যমে সমাজের কল্যাণে সরকারের ভুলগুলো তুলে ধরুন। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা কোনো অপরাধ নয়।

৩। গঠনমূলক প্রস্তাবনা দিনঃ সমালোচনার পাশাপাশি, সমাধানের পথও দেখান। শুধুমাত্র সরকারের ভুল ধরিয়ে দেওয়া নয়, বরং কিভাবে তা সংশোধন করা যায় তার জন্য গঠনমূলক পরামর্শ দেওয়া সরকারের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য ও সম্মানজনক উপায় হতে পারে।

৪। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করুন সচেতনতার সাথেঃ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মতামত প্রকাশের সময় এমন কিছু লিখবেন না যা বিদ্বেষ বা ঘৃণা ছড়াতে পারে। মন্তব্য বা পোস্ট এমনভাবে লিখুন যাতে জনগণ এবং সরকার উভয়েই বিষয়টি বোঝে এবং একে সমাজের কল্যাণের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে।

৫। আইনি ও সাংবিধানিক পদ্ধতি অবলম্বন করুনঃ সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গেলে সংবিধানসম্মত এবং আইনি পদ্ধতিতে প্রতিবাদ করুন। অবৈধ পথে না গিয়ে, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, লিখিত অভিযোগ, বা গণমাধ্যমে নিবন্ধের মাধ্যমে আপনার অবস্থান তুলে ধরতে পারেন।

৬। বাকস্বাধীনতার অধিকারকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করুনঃ মত প্রকাশের স্বাধীনতা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। আপনার বক্তব্য যেন জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি বা বিভাজন সৃষ্টি না করে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে মতামত প্রকাশ করা জরুরি।

৭। সরকারি নীতির পরিবর্তন চাইলে আইনি উপায় অনুসরণ করুনঃ যদি আপনি কোনো সরকারি নীতি পরিবর্তন করতে চান, তাহলে তা আইনি উপায়ে করতে হবে। আপনি জনমত তৈরি করতে পারেন, সংসদে প্রতিনিধি বা নির্বাচিত সদস্যের মাধ্যমে দাবি জানাতে পারেন, কিন্তু সরাসরি বিদ্রোহ বা শত্রুতা ছড়ানো যাবে না।

৮। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা রাখুনঃ সরকারের সমালোচনা করার সময় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন। এমন কোনো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবেন না যা গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তিকে দুর্বল করে।

৯। বিচ্ছিন্নতাবাদী বা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকুনঃ কোনো ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী বা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের সাথে জড়িত হবেন না। শান্তিপূর্ণ উপায়ে দেশের উন্নতি ও কল্যাণে অবদান রাখুন।

১০। গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার নিয়মাবলি মেনে চলুনঃ গণমাধ্যমে বক্তব্য প্রদান করলে তা যেন তথ্যসমৃদ্ধ ও গঠনমূলক হয়। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করার উদ্দেশ্যে তথ্য প্রচার না করে, বরং সরকারের দুর্বলতা তুলে ধরার পাশাপাশি জনগণের উন্নয়নের দিকও আলোচনা করুন।

দণ্ডবিধির ধারা ১২৪ক জনগণকে সরকার বিরোধী ঘৃণা ছড়ানো থেকে বিরত রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটি এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যাতে নাগরিকেরা আইনি উপায়ে সরকারের সমালোচনা করতে পারেন। অতএব, এই ধারা নাগরিকদের জন্য একটি সতর্কবার্তা প্রদান করে, যেন তারা সঠিক উপায়ে তাদের মতামত প্রকাশ করে, অন্যথায় শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। নাগরিকদের উচিত গঠনমূলক সমালোচনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে সরকারের ভুলগুলো তুলে ধরা, তবে তা এমনভাবে করতে হবে যাতে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও সংহতি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। শান্তিপূর্ণ, আইনি এবং দায়িত্বশীল পদ্ধতিতে মত প্রকাশের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করা যেতে পারে।

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.