পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ এর আদ্যোপান্ত 

পারিবারিক আইন

বাংলাদেশে পিতা-মাতা এবং তাদের পূর্বসূরিদের (দাদা-দাদী, নানা-নানী) ভরণ-পোষণকে নিশ্চিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন হলো পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩। এই আইনের উদ্দেশ্য হলো সমাজে বয়স্কদের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব এবং কর্তব্যকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরার পাশাপাশি বার্ধক্যে নিজেদের ভরণপোষণ তাদের উত্তরাধিকারদের কাছ থেকে নিশ্চিত করা। 

আমাদের দেশের বেশীরভাগ মানুষই সম্পত্তির মালিক হয় পিতা-মাতা, তথা দাদা-দাদী ও নানা-নানীর কাছ থেকে। কেননা, আমি যদি আমার পিতার কাছ থেকে সম্পত্তি পেয়ে থাকি, আমার পিতাও সম্পত্তি পেয়েছেন ওনার পিতার কাছ থেকে, অর্থাৎ আমার দাদার কাছ থেকে। সেক্ষেত্রে আমি আমার পিতার ভরণপোষণের জন্য যেমন দায়িত্ববান হওয়া উচিত, তেমনি আমার পিতার অবর্তমানে দাদার ভরণপোষণেরও দায়িত্ব আমার কাঁধে। আবার একটু পিছনে গিয়ে যদি আমরা দেখি তাহলে দেখতে পাবো যে, আমাদের জন্ম থেকে নিজেরা নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর পূর্ব পর্যন্ত আমাদের পিতা মাতাই আমাদের ভরণপোষণ নিশ্চিত করেছেন আর পিতা অবর্তমানে দাদা দাদি, মাতার অবর্তমানে নানা নানী আমাদের দেখভাল করেছেন। তাহলে, আমাদের উপর দায়িত্বটি কোন মতেই আমাদের উপর ছাপিয়ে দেওয়া হয়, বরং এটিই প্রাকৃতিক নিয়ম। যাই হোক, সেই প্রাকৃতিক বা সামাজিক নিয়মকে এখন আমরা আইন করে নিয়েছি যাতে সেটি শুধুমাত্র নৈতিক দায়িত্বে আবদ্ধ না থেকে বরং আইনত বাধ্যতামূলক হয়ে উঠে। তো চলুন দেখি আইন কি বলে…

 

পিতা-মাতার ভরণ-পোষণঃ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ এর ধারা ৩ অনুযায়ী, প্রত্যেক সন্তানের দায়িত্ব তার পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করা। ভরণ-পোষণ বলতে শুধুমাত্র খাওয়া-দাওয়া নয়, বরং তাদের সাথে বসবাসের সুবিধা, চিকিৎসা সেবা এবং সঙ্গ প্রদানও অন্তর্ভুক্ত। 

উদাহরণস্বরূপ, পলাশ তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তার বাবার বয়স হয়ে যাওয়ায় পলাশকে নিয়মিতভাবে তার বাবার চিকিৎসা এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তাগুলো নিশ্চিত করতে হয়। তবে যদি পলাশ তার দায়িত্ব পালন না করে এবং তার মা-বাবাকে বৃদ্ধ নিবাসে পাঠানোর চেষ্টা করে, তবে এটি আইন অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

পিতা-মাতার জন্য একত্রে বসবাসঃ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ অনুসারে, সন্তানদের পিতা-মাতাকে একত্রে একই স্থানে বসবাসের সুযোগ দিতে হবে। এটি বয়স্ক পিতা-মাতার মানসিক শান্তির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, রিতা এবং তার ভাই-বোনদের নিজেদের পিতা-মাতাকে ভরণ-পোষণ দিতে হয়। তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয় যে, তাদের মা-বাবা তাদের সাথে একই ঘরে থাকবেন। কিন্তু রিতার এক ভাই তার বাবা-মাকে আলাদা বাসায় পাঠানোর চেষ্টা করে। এই ধরণের কাজটি আইন অনুযায়ী ঠিক নয়।

দাদা-দাদী এবং নানা-নানীর ভরণ-পোষণঃ পিতা-মাতার অনুপস্থিতিতে, সন্তানের দায়িত্ব তাদের দাদা-দাদী এবং নানা-নানীর ভরণ-পোষণ করা। পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ এর ধারা ৪ এ বলা হয়েছে যে, পিতা বা মাতা না থাকলে তাদের পূর্বপুরুষদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব সন্তানের উপর পড়বে। উদাহরণস্বরূপ, পলাশের পিতা-মাতা কেউই জীবিত নেই। এই ক্ষেত্রে, পলাশের দায়িত্ব তার দাদা-দাদী এবং নানা-নানীর ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করা। তাদের যত্ন না নিলে, এটি আইন অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন অনুযায়ী ভরণ-পোষণ না করায় শাস্তিঃ যদি কোন সন্তান তার পিতা-মাতা বা পূর্বপুরুষদের ভরণ-পোষণ না করে, তবে সে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা ৩ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে।

যেমন, রিতা যদি তার বৃদ্ধ মা-বাবার ভরণ-পোষণ না করে এবং আদালতে এটি প্রমাণিত হয়, তবে রিতা আইন অনুযায়ী শাস্তির সম্মুখীন হতে পারে। একইভাবে, পলাশ যদি তার দাদা-দাদীর প্রতি কোন দায়িত্ব পালন না করে, তবে সেও একই শাস্তির আওতায় আসবে।

অপরাধের ধরনঃ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, কিংবা নানা-নানীর ভরণ-পোষণ না করা একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। এই অপরাধটি আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য এবং আপোষযোগ্য বলে আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। এর অর্থ হলো, এই অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই ব্যবস্থা নিতে পারে, অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনের জন্য আবেদন করতে পারেন এবং উভয় পক্ষের মধ্যে আপোষের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। যেমন, পলাশ যদি তার বৃদ্ধ বাবা-মাকে ভরণ-পোষণ না করে এবং এ নিয়ে তার বাবা-মা আদালতে অভিযোগ করেন, তাহলে পুলিশ সেই অভিযোগ আমলে নিবেন। পলাশ আদালতে জামিনের জন্য আবেদন করতে পারবে এবং দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা করে আপোষের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা যেতে পারে।

বিচার প্রক্রিয়াঃ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ এর ধারা ৭ অনুযায়ী, এই আইনের অধীন যে কোন অপরাধ ১ম শ্রেণীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচারযোগ্য হবে। তবে, আদালত শুধুমাত্র সেই অভিযোগ আমলে নিবে যেখানে পিতা বা মাতা, বা ক্ষেত্রমত, দাদা-দাদী বা নানা-নানী লিখিতভাবে অভিযোগ দাখিল করবেন। 

আপোষ-নিষ্পত্তিঃ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ এর ধারা ৮ অনুযায়ী, আদালত অভিযোগ প্রাপ্তির পর সেটি আপোষ-নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র কিংবা অন্য কোন উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে পাঠাতে পারে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি উভয় পক্ষকে শুনানির সুযোগ দিয়ে সমস্যাটির সমাধান করার চেষ্টা করবেন। যদি আপোষের মাধ্যমে সমস্যা নিষ্পত্তি হয়, তবে সেটিকে আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তিকৃত বলে গণ্য করা হবে।

 

বাংলাদেশে পিতা-মাতা এবং পূর্বপুরুষদের প্রতি সন্তানের দায়িত্বকে কেন্দ্র করে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ প্রণীত হয়েছে। এই আইনটি সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি সন্তানকে তার পিতা-মাতা এবং পূর্বপুরুষদের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে, তা না হলে আইন অনুযায়ী শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। তবে পরিবার প্রথা সুষ্ঠু রাখতে এই আইনের অধীন অপরাধের ক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়া সহজ, জামিনের সুযোগ রয়েছে এবং আপোষের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানও সম্ভব। এই আইনটি শুধু আইনি বাধ্যবাধকতা নয়, বরং আমাদের সমাজের পারিবারিক বন্ধনকে শক্তিশালী করার একটি মাধ্যমও বটে। ধন্যবাদ। 

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.