চেকের মামলায় লিগ্যাল নোটিশে যে বিষয়গুলো থাকে এবং যেভাবে পাঠাতে হয়

ব্যবসায়িক আইন

আমরা জানি, চেকের মামলায় একটি লিগ্যাল বা আইনি বা উকিল নোটিশ, যা সাধারণত চেক ডিজঅনার হওয়ার পর চেক দাতাকে টাকা পরিশোধের জন্য পাঠানো হয়। নোটিশের মূল উদ্দেশ্য হলো, চেক দাতাকে শেষবারের মতো টাকা পরিশোধের সুযোগ দেয়া এবং তাকে আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবগত করা। নিচে এই নোটিশে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে এমন বিষয়গুলো উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করা হলো, যা আপনি নোটিশ দাতা বা নোটিশ দাতার পক্ষে আইনজীবী উভয়ের জন্যই উপকারে আসবেঃ 

১। নোটিশ দাতা এডভোকেটের নাম ও ঠিকানাঃ নোটিশে প্রথমেই নোটিশ দাতা এডভোকেটের নাম ও ঠিকানা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, “এডভোকেট চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক, শাহবাগ, ঢাকা-১০০০।” নামটা আমার হলেও ঠিকানাটা কাল্পনিক। এখানে আইনজীবী নিজের নাম লিখবেন এবং নিজের চেম্বারের ঠিকানা দিবেন।

২। নোটিশ প্রেরক অর্থাৎ চেক গ্রহীতা তথা বাদীর নাম, ঠিকানা ও পরিচয়ঃ চেক গ্রহীতা বা বাদীর নাম, ঠিকানা এবং পরিচয়ও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, “বাদী জনাব মো. হাসান আলী, সেক্টর-১০, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০।”

৩। নোটিশ প্রাপক অর্থাৎ চেক দাতার নাম, ঠিকানা ও পরিচয়ঃ চেক দাতার নাম, ঠিকানা এবং পরিচয় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, “চেক দাতা জনাব মাহমুদুল হাসান, গুলশান-২, ঢাকা-১২১২।”

৪। লেনদেন সংক্রান্ত ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ নোটিশে পক্ষদের মধ্যে যে লেনদেন হয়েছে তা সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, “বাদী ও আসামীর মধ্যে একটি ব্যবসায়িক লেনদেনের মাধ্যমে বাদী আসামীর কাছে ৫,০০,০০০ টাকা ধার দিয়েছিলেন।”

৫। চেকে স্বাক্ষর ও হস্তান্তর সংক্রান্ত বর্ণনাঃ আসামী কর্তৃক চেকে স্বাক্ষর এবং তা বাদীর কাছে হস্তান্তরের বর্ণনা দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, “আসামী তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের চেক নম্বর ১২৩৪৫৬ স্বাক্ষরিত করে বাদীর কাছে হস্তান্তর করেন।”

৬। পাওনা টাকার পরিমাণঃ চেকের মাধ্যমে কত টাকা পাওনা আছে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, “পাওনা টাকার পরিমাণ ৫,০০,০০০ টাকা।”

৭। চেক নম্বর, তারিখ ও টাকার পরিমাণঃ চেকের নম্বর, প্রদানের তারিখ এবং টাকার পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, “চেক নম্বর ১২৩৪৫৬, ১লা জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে, ৫,০০,০০০ টাকা।” সবই কিন্তু এখানে কাল্পনিক, আপনারা কিন্তু সঠিক তথ্য দিবেন। 

৮। চেক জমা দেয়ার তারিখ ও ব্যাংকের নামঃ চেকটি কোন তারিখে এবং কোন ব্যাংকে জমা দেয়া হয়েছে তা উল্লেখ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, “চেকটি ১০ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে সোনালী ব্যাংক, মতিঝিল শাখায় জমা দেয়া হয়।”

৯। চেক ডিজঅনার হওয়ার তারিখ ও কারণঃ চেকটি কখন ডিজঅনার হয়েছে এবং তার কারণ উল্লেখ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, “চেকটি ১২ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে ডিজঅনার হয়, কারণ: ‘অপর্যাপ্ত অর্থ’।”

১০। আদায়ের জন্য ৩০ দিনের সময় প্রদানঃ আসামীকে চেকে বর্ণিত টাকা পরিশোধের জন্য ৩০ দিনের সময় দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, “আপনাকে ৩০ দিনের মধ্যে চেকে বর্ণিত টাকা পরিশোধের অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

১১। নোটিশের একটি কপি সংরক্ষণঃ নোটিশের একটি কপি এডভোকেটের সেরেস্তায় সংরক্ষণ করার বিষয়ে উল্লেখ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, “এই নোটিশের একটি কপি আমার সেরেস্তায় সংরক্ষিত রয়েছে।”

১২। এডভোকেটের স্বাক্ষর, তারিখ ও সীল মোহরঃ নোটিশে এডভোকেটের স্বাক্ষর, তারিখ এবং সীল মোহর থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, “এডভোকেট চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক, স্বাক্ষরিত, ১৫ জানুয়ারি ২০২৪।”

১৩। নোটিশ প্রেরণের তারিখ ও সূত্রঃ নোটিশ প্রেরণের তারিখ এবং সূত্র উল্লেখ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, “এই নোটিশটি রেজিস্ট্রি ডাকযোগে ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে প্রেরণ করা হলো।”

এই বিষয়গুলো যথাযথভাবে নোটিশে অন্তর্ভুক্ত না হলে, মামলা পরিচালনায় সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। তাই প্রতিটি বিষয় স্পষ্ট ও সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি।

নোটিশ তো তৈরি হয়ে গেলো, এখন এই নোটিশটি আসামীর কাছে কিভাবে পাঠাবেন বা কিভাবে জারি করবেন, আসুন সেই বিষয়টি দেখি। চেকের মামলায় নোটিশ জারির পদ্ধতি হলো একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে চেক ডিজঅনারের জন্য দায়ী ব্যক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নোটিশ প্রদান করা হয়। ২০০৬ সনের ৩ নং আইন দ্বারা ১৩৮ ধারায় একটি নতুন উপ-ধারা যুক্ত করা হয়, যা ৯ই ফেব্রুয়ারি ২০০৬ থেকে কার্যকর হয়েছে। এই আইনের অধীনে চেকের মামলায় নোটিশ জারির তিনটি পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে, যা নিচে সহজ ভাষায় উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করা হলোঃ 

১। নোটিশ সরাসরি প্রদানঃ নোটিশটি সরাসরি সেই ব্যক্তির হাতে পৌঁছে দিতে হবে যিনি চেক দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, “যদি আপনি একটি চেকের মামলা দায়ের করতে চান এবং চেকের মালিক (দাতা) আপনার প্রতিবেশী হন, তাহলে আপনি নিজে গিয়ে বা আপনার আইনজীবীর মাধ্যমে তাকে নোটিশটি সরাসরি দিয়ে আসতে পারেন।”

২। রেজিস্ট্রি ডাকযোগে নোটিশ প্রেরণঃ নোটিশটি রেজিস্ট্রি ডাকযোগে প্রেরণ করতে হবে সেই ঠিকানায় যেখানে চেক দাতা নিয়মিত বসবাস করেন বা সর্বশেষ যেখানে বসবাস বা ব্যবসা করেছেন। এটি নিশ্চিত করার জন্য, প্রাপ্তিস্বীকার পত্র (Acknowledgement Due বা A/D) সহ নোটিশ পাঠাতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, “ধরুন চেক দাতা ঢাকার ধানমন্ডিতে থাকেন। তাহলে আপনি তাকে রেজিস্ট্রি ডাকযোগে নোটিশটি প্রেরণ করবেন এবং তার প্রাপ্তিস্বীকার পত্র সংরক্ষণ করবেন, যাতে প্রমাণ থাকে যে তিনি নোটিশটি পেয়েছেন।”

৩। জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশঃ যদি চেক দাতার ঠিকানা অজানা থাকে বা তাকে খুঁজে পাওয়া না যায়, তাহলে জাতীয় বাংলা দৈনিক পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, “ধরুন চেক দাতার ঠিকানা পাওয়া যাচ্ছে না। এই ক্ষেত্রে, আপনি একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকায় নোটিশটি প্রকাশ করবেন, যাতে চেক দাতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবগত করা হয়।”

“যদি কেউ প্রথমেই রেজিস্ট্রি ডাকযোগে নোটিশ প্রেরণ করেন এবং সেই প্রক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়, তবে তার আর পত্রিকায় নোটিশ প্রকাশ বা সরাসরি নোটিশ প্রদান করার প্রয়োজন নেই। তিনটি পদ্ধতির যেকোনো একটি সফলভাবে সম্পন্ন হলে সেটি যথেষ্ট।”আশা করি বুঝতে পেরেছেন, ধন্যবাদ। 

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.