দেওয়ানী মোকদ্দমা

দেওয়ানী মোকদ্দমার পক্ষসমূহ এবং খুঁটিনাটি

দেওয়ানি আইন

আমরা জানি, দেওয়ানী মোকদ্দমা সাধারণত দুই ধরনের পক্ষ থাকে, যথা:
১) বাদী পক্ষ, ২) বিবাদী পক্ষ।

বাদী পক্ষ: আমরা সবাই জানি যে পক্ষ মামলা দায়ের করে থাকে তাকে বাদী পক্ষ বলা হয়ে থাকে।
বিবাদী পক্ষ: বাদী যার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে, তাকে বলা হয় বিবাদী পক্ষ।

এখন সহজ ভাষায় বুঝতে গেলে, আপনি যখন আপনার কোন অধিকার বা দাবী আদায় করার জন্য কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবেন, তখন আপনাকে বলা হবে বাদী। আর, আপনি যে বা যাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবেন, তাদেরকে বলা হবে বিবাদী। সহজেই মনে রাখার কৌশল হচ্ছে, যে মামলা করে, সে হচ্ছে বাদী আর যার বিরুদ্ধে মামলা করা হয় বা গ্রামের ভাষায় যে মামলা খায় তাকে বলা হয় বিবাদী।

 

এখানে উল্লেখ্য, ফৌজদারি মামলায় যখন কেউ সিআর মামলা করে তখন সে হয় বাদী, আর জিআর মামলার ক্ষেত্রে বাদী হয় রাষ্ট্র। আর, যার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়, তাকে বলা হয় অভিযুক্ত/আসামী।
আরও উল্লেখ্য, আমরা প্রায়ই বলার সময় বলে ফেলি যে, দেওয়ানী মামলা বা সিভিল মামলা; যা আসলে ভুল। ‘মামলা’ শব্দটি ব্যবহার করা হবে ফৌজদারি বা ক্রিমিনাল বিষয়ে। আর, দেওয়ানী বা সিভিল বিষয়ে ব্যবহার করতে হবে ‘মোকদ্দমা’ শব্দটি। ইংরেজিতে দেখবেন, ফৌজদারি বা ক্রিমিনাল বিষয়ে লেখা হয় case (কেস) আর দেওয়ানী বা সিভিল বিষয়ে লেখা হয় suit (স্যুট)। উভয় ক্ষেত্রে, আইনের ভাষা ভিন্ন হলেও ভাবার্থ কিন্তু একই।

 

তাহলে এতক্ষণে আমরা যখন বাদী এবং বিবাদী সম্বন্ধে জানলাম, তখন এটাও মনে রাখি যে, একটি দেওয়ানী মোকদ্দমায় বাদী এক বা একাধিক হতে পারে এবং বিবাদীর ক্ষেত্রেও বিবাদী এক বা একাধিক হতে পারেন।

দেওয়ানী কার্যবিধির ১ নং আদেশে মোকদ্দমার পক্ষসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আমরা উক্ত আদেশ থেকে পক্ষসমূহ সম্বন্ধে মৌলিক আলোচনা করবো এবং জানার চেষ্টা করবো, একটি দেওয়ানী মোকদ্দমায় পক্ষ কারা এবং তাদের সম্বন্ধে খুঁটিনাটি।

  • প্রয়োজনীয় পক্ষ বা Necessary Party- মোকদ্দমার যে পক্ষের উপস্থিতি অপরিহার্য বা বলা যায় যে, যার অনুপস্থিতিতে কার্যকরী কোন ডিক্রি প্রদান করা যায় না, সেই পক্ষকে বলা হয়, প্রয়োজনীয় পক্ষ বা Necessary Party.
  • উপযুক্ত পক্ষ বা Proper Party- মোকদ্দমার যে পক্ষের অনুপস্থিতিতে কার্যকরী কোন আদেশ প্রদান করা গেলেও পূর্ণাঙ্গ এবং চূড়ান্ত রায় দেওয়া যায় না, সেই পক্ষকে বলা হয়, উপযুক্ত পক্ষ বা Proper Party.
  • অ-সংযুক্ত বা Non-joinder- প্রয়োজনীয় পক্ষ বা উপযুক্ত পক্ষ সম্বন্ধে আমরা একটু আগেই দেখলাম। এখন যদি, কোন মোকদ্দমায় আপনি প্রয়োজনীয় পক্ষ বা উপযুক্ত পক্ষ কাউকেই অন্তর্ভুক্ত না করেন তাহলে তাদের অনুপস্থিতিকে বলা হবে, অ-সংযুক্ত বা Non-joinder.
  • অপসংযোগ বা Mis joinder- কোন মোকদ্দমায় আপনি প্রয়োজনীয় পক্ষ বা উপযুক্ত পক্ষ কাউকেই অন্তর্ভুক্ত না করে, উল্টো এমন কাউকে সংযুক্ত করেছেন যে কিনা না প্রয়োজনীয়, না উপযুক্ত, তখন তাকে বলা হবে, অপসংযোগ বা Mis joinder.

 

অ-সংযুক্ত বা Non-joinder এবং অপসংযোগ বা Mis joinder এর ক্ষেত্রে আদালত অপ্রয়োজনীয় পক্ষকে কর্তন করে যথাক্রমে প্রয়োজনীয় বা উপযুক্ত পক্ষ সংযুক্ত করার আদেশ দিতে পারেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, বাদী বিবাদী উভয় ক্ষেত্রেই হতে পারে।

তাছাড়া, যদি কোন মোকদ্দমায় ভুল বাদীর নাম দিয়ে মোকদ্দমা দায়ের করা হয়, তবে আদালত মোকদ্দমার যেকোনো পর্যায়ে সঠিক বাদীকে সংযুক্ত বা Addition করতে পারেন। আবার, ফুটবল খেলায় আমরা যেমন খেলোয়াড় উঠিয়ে নেওয়া বা পরিবর্তন করতে দেখি, যাকে কিনা আমরা স্থলাভিষিক্ত বা Substitution বলে থাকি, সেটির মাধ্যমেও আদালত ভুল বাদীর পরিবর্তে সঠিক বাদীকে স্থলাভিষিক্ত করার আদেশ দিতে পারেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, সংযুক্ত বা স্থলাভিষিক্ত শুধু বাদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

 

প্রতিনিধিত্ব মূলক মোকদ্দমা বা Representative Suit – যখন একটি দেওয়ানী মোকদ্দমায় একের অধিক ব্যক্তির স্বার্থ জড়িত থাকে তখন তাদের সকলের পক্ষে একজন মোকদ্দমা পরিচালনা করতে পারে। এই সুযোগটি কিন্তু জনগণের স্বার্থে এবং বলতে গেলে বেশ উপযোগী একটি উপায়। আমরা জানি, প্রতিটি জেলায় একটি করে জেলা জজ আদালত রয়েছে, যেখানে গিয়ে ঐ জেলা দেওয়ানী মোকদ্দমা গুলো দায়ের করতে হয়। এখন, প্রতিটি জেলার ঠিক জেলা শহরেই সাধারণত আদালত গুলো প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। এখন দেখা যায় যে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন মানুষকে তার জেলা শহরে তথা জেলা আদালতে উপস্থিত হতে হলে যে সময় এবং অর্থ খরচ হয়, তা একজনের পক্ষেই বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে যায়, সেখানে যখন একই বিষয়বস্তুতে একাধিক মানুষকে ২/১ মাস পরপর দলবল নিয়ে আদালতে উপস্থিত হতে হয়, তখন সেটি দেখা যায় যে মোকদ্দমার মূল্যমানের চেয়েও বেশি খরচ সাপেক্ষ। কেননা আমরা জানি যে, একটি দেওয়ানী মোকদ্দমার বিচারকার্য শেষ হতে বছরের পর বছর লেগে যায়, যার ফলে মোকদ্দমার মূল্যমানের চেয়ে আদালতে যাওয়া আসার খরচই আরও বেশি পড়ে যায়। তাছাড়া, অনেক সময় বয়স্ক কেউ থাকলে তার জন্য সেটি কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে আদালতে যাওয়া আসা আবার কর্মের সুবাদে অনেকেই নিজ এলাকায় সবসময় অবস্থান করতে পারে না। এর জন্য, আজ একজন আসে তো কাল আরেকজন আসতে পারে না, অসুস্থতার অজুহাতে সময়ের আবেদন ইত্যাদি নানা জটিলতায় মোকদ্দমা চলতে থাকে বছরের পর বছর। Justice delay means justice deny, তাই বাদী এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে প্রতিনিধিত্বমূলক মোকদ্দমা বা Representative Suit এর মাধ্যমে খরচ, সময় এবং শ্রমকে বাঁচিয়ে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারে। তবে, এর জন্য অবশ্যই আদালতের অনুমতি নিতে হবে।

 

এই হচ্ছে, দেওয়ানী কার্যবিধির ১ আদেশ অনুযায়ী দেওয়ানী মোকদ্দমার পক্ষসমূহ এবং এর খুঁটিনাটি। আমরা পর্যায়ক্রমে দেওয়ানী কার্যবিধির বিভিন্ন আদেশ নিয়ে আলোচনা করবো, যাতে দেওয়ানী মোকদ্দমা সম্বন্ধে একটি মৌলিক ধারনা পাওয়া যায়। চোখ রাখুন এবং বুকমার্কে সংরক্ষণ করে রাখুন লিগ্যালফিস্ট ডট কম

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.