আরজি খারিজ

যেসব কারণে আপনার আরজিটি খারিজ হতে পারে

দেওয়ানি আইন

একটি ফৌজদারি বা ক্রিমিনাল অপরাধ হলে আমরা সাধারণত থানায় অভিযোগ করি কিংবা আদালতে মামলা দায়ের করি। সেই ক্ষেত্রে আদালত বা থানা আমাদের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে কিনা সেটি যাচাই করে, তারপর মামলার কার্যক্রম সামনের দিকে অগ্রসর করিয়ে থাকেন। ঠিক তেমনিভাবে একটি দেওয়ানী বা সিভিল মোকদ্দমায় আপনি যখন কোন দেওয়ানি প্রতিকার চেয়ে মোকদ্দমা দায়ের করবেন সেই ক্ষেত্রে আপনার আরজিটি প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করা হবে আপনার দায়ের কৃত আরজিটি যদি আদালতের কাছে সঠিক বলে মনে হয়, তাহলে আদালত সেটি গ্রহণ করবেন এবং বিবাদীকে সমন পাঠাবেন। কিন্তু আদালত যদি মনে করেন আপনার আরজিটি নিয়ম অনুসারে সঠিক নয়, সেই ক্ষেত্রে আদালত চাইলে আরজিটি নাকচ বা খারিজ বা প্রত্যাখ্যান বা বাতিল করে দিতে পারেন, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Rejection of Plaint (রিজেকশন অফ প্লেইন্ট)।

দেওয়ানি কার্যবিধির আদেশ ৭ এর ১১ নং বিধি অনুসারে আদালত নিম্নে বর্ণিত চারটি কারণে একটি আরজি খারিজ বা নাকচ করতে পারেন। কারণগুলো নিম্নরূপ:

  • প্রথমত, আরজিতে মামলার কারণ উল্লেখ না থাকলে আদালত উক্ত আরজি নাকচ বা খারিজ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে। কেননা আপনি একটি মোকদ্দমা দায়ের করবেন, সেই মোকদ্দমা দায়ের করার পেছনে অবশ্যই আপনার কোন কারণ রয়েছে যাকে আমরা ইংরেজিতে বলি Cause of Action (কজ অফ একশন)। কিন্তু আপনি যদি আরজিতে ওই কজ অফ একশন/মামলার কারণ উল্লেখ না করেন, তাহলে আদালত আপনার মামলা করার কারণ সম্বন্ধে কিভাবে বোধগম্য হবেন? আদালত তো অন্তর্যামী নন, তাই আদালত উক্ত আরজিটি খারিজ বা নাকচ বা প্রত্যাখ্যান করে দিবেন।
  • দ্বিতীয়ত, আরজিতে মোকদ্দমার বিষয়বস্তুর মূল্য কম উল্লেখ করা হলে এবং আদালতের নির্দেশ দেওয়ার পরও বাদী যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ২১ দিনের মধ্যে মোকদ্দমার বিষয়বস্তুর সঠিক মূল্য লিখতে ব্যর্থ হয়, সেই ক্ষেত্রে আদালত উক্ত আরজিটি খারিজ বা নাকচ বা প্রত্যাখ্যান করে দিতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই আপনি আদালতের কাছে একটি প্রতিকার চাওয়ার আশায় আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করেন, কিন্তু আপনি আপনার প্রতিকারের মূল্য যদি সঠিকভাবে নির্ধারণ করে না দেন, সেই ক্ষেত্রে সেটি আদালতের এখতিয়ার যেমন সঠিক নির্ধারণে সমস্যা করে, তেমনি রাষ্ট্রেরও সঠিক বা ন্যায্য রাজস্ব আদায় নয় না, অর্থাৎ রাষ্ট্র তার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় আদালত বাদিকে ২১ দিনের সময় দিবেন, ২১ দিনের মধ্যে যদি বাদি তার দাবীকৃত প্রতিকারের মূল্য সঠিকভাবে লিখতে সক্ষম হয়, সে ক্ষেত্রে আদালত আরজি গ্রহণ করবে অন্যথায় আদালত বাদীর আরজিটি খারিজ বা নাকচ বা প্রত্যাখ্যান করে দিবেন।
  • তৃতীয়ত, আদালতে একটি আরজি দাখিল করার সময় প্রয়োজনীয় স্ট্যাম্প যুক্ত কাগজে আরজি লিখতে হয়। কিন্তু কেউ যদি বা আপনি যদি প্রয়োজনের তুলনায় কম মূল্যের স্ট্যাম্প যুক্ত কাগজে আরজি লিখেন, সেই ক্ষেত্রে আদালত প্রথমত আপনাকে ২১ দিনের সময় দিবে, আপনাকে ২১ দিন সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় স্ট্যাম্প পেপার সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু আপনি যদি ২১ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় স্ট্যাম্প পেপারে সরবরাহ করতে ব্যর্থ হন, সেই ক্ষেত্রে আপনার আরজিটি আদালত খারিজ বা প্রত্যাখ্যান করে দিবেন।
    প্রত্যেকটি প্রসিডিউরাল বিষয়ে আদালত/আইন যেটি যেভাবে নির্ধারণ করে দিয়ে থাকেন, সেটি ঠিক সেই ভাবেই অনুসরণ করতে হয় যদি আদালতের কাছ থেকে আপনার প্রতিকার পেতে হয়। মামলা ভেদে বিভিন্ন মূল্যের স্ট্যাম্প যুক্ত কাগজে আরজি লিখতে হয়, তাই সঠিক মূল্যের স্ট্যাম্প যুক্ত কাগজে আরজি লেখা না হলে, সেটি প্রসিডিউরগত অমান্য হিসেবে গণ্য করা হবে। কিন্তু অনেক সময় সেটি না জানার কারণেও হয়ে থাকে বলে আদালত ২১ দিনের সময় দিয়ে থাকেন, যাতে সেটি সংশোধন করে নেওয়া যায়। কিন্তু উক্ত সময়ের মধ্যেও যদি কেউ সেটি সংশোধন করিয়ে না নেয় বা সংশোধন না করে সে ক্ষেত্রে তার আরজি খারিজ বা প্রত্যাখ্যান করা হয়।
  • চতুর্থত, আপনি যে বিষয়ে মোকদ্দমা দায়ের করতে আরজি দাখিল করেছেন সেই বিষয়টি যদি আইন অনুসারে নিষিদ্ধ বা বারিত হয়, তাহলে সেই আরজিটি আদালত খারিজ করে দিবেন। যেমন ধরুন, দেনমোহর আদায় করার জন্য যে মোকদ্দমা দায়ের করা হয় তার তামাদি মেয়াদ হচ্ছে তিন বছর। এখন আপনি যদি বিলম্বিত দেনমোহর আদায়ের জন্য আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করেন বিবাহ বিচ্ছেদের তিন বছরের পরে যেখানে কিনা ইতিমধ্যে তামাদি মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, সেই ক্ষেত্রে আদালত আপনার উক্ত আরজিটি খারিজ বা প্রত্যাখ্যান করে দিবেন। আবার ধরুন, আপনি কারো সাথে এমন একটি চুক্তি করেছেন যেটি আইনগতভাবে সম্ভব নয় বা যে ধরনের চুক্তি আইনত অবৈধ সেই ধরনের কোন যুক্তি যদি আপনি আদালতের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাতে চান, সেই ক্ষেত্রে সেই মোকদ্দমা দায়েরের জন্য যে আরজি দাখিল করবেন, সেই আরজিটি আদালত নাকচ বা প্রত্যাখ্যান বা খারিজ করে দিতে পারেন।

এছাড়াও কোন মোকদ্দামায় যদি একাধিক বিবাদী থাকে সেই ক্ষেত্রে আরজির সাথে প্রত্যেক বিবাদীর প্রতি আরজির অনুলিপি, সমনের অনুলিপি এবং সার্ভিসের ফিস জমা দিতে হবে। অন্যথায় আদালত চাইলে উক্ত আরজি নাকচ বা প্রত্যাখ্যান বা খারিজ করে দিতে পারেন।

তবে আদালত আপনার আরজি নাকজ বা প্রত্যাখ্যান বা খারিজ করে দিলে আপনি প্রতিকার পেতে বঞ্চিত হবেন তা কিন্তু নয়। আপনি চাইলে ফ্রেশ আরেকটি আরজি দাখিল করতে পারেন অথবা আরজি খারিজ বা প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত যেহেতু একটি ডিক্রি, সেই ক্ষেত্রে আদালত যদি কোন আরজিকে খারিজ বা প্রত্যাখ্যান করে দেয়, সেই ক্ষেত্রে বাদি দেওয়ানী কার্যবিধির ৯৬ দ্বারা অনুসারে আরজি খারিজের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। আজ এই পর্যন্ত, ধন্যবাদ৷

close

Subscribe

Subscribe to get an inbox of our latest blog.